August 1, 2025

প্রতিঘাতের ছায়ায়!!

 প্রতিঘাতের ছায়ায়!!

২৮জুলাই,২০২৫।একই তারিখে ভারতের দুই মঞ্চে একসঙ্গে ‘দুটি ঘটনা ঘটল। একদিকে সংসদ ভবনের লোকসভার অন্দরে উচ্চৈঃস্বরে বিরোধীদের সম্মিলিত আক্রমণ, অন্যদিকে শ্রীনগরের অদূরে পাহাড়ি অরণ্যে এক নির্ধারিত সামরিক অভিযান।দিল্লীতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং যখন ‘অপারেশন সিন্দুর’ নিয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করছেন এবং বিরোধীদের প্রবল প্রশ্নাবলির মুখোমুখি হচ্ছেন, তখন প্রায় একই সময় কাশ্মীরে সেনাবাহিনী চালিয়েছে ‘অপারেশন মহাদেব’। দিনটাও ছিল ঘটনাচক্রে মহাদেবের আরাধনার দিন, সোমবার! সরকারের দাবি, ওই অভিযানে নিহত হয়েছে পহেলগাঁও সন্ত্রাসবাদী হামলার মূল চক্রী সুলেমান শেখ সহ তিন জঙ্গি।
যে সময়াবধিতে এই দুই ঘটনা ঘটল,তা নিছক কাকতালীয় হতে পারে না। সংসদে বিরোধীরা যখন জবাব চাইছিলেন, ভারত কেন ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে নিজেদের ছাব্বিশজন নিরীহ মানুষকে হারাল, কেন সীমান্তে আগাম সতর্কতা ছিল না, কেন গোয়েন্দা তথ্য থাকা সত্ত্বেও জঙ্গিরা হামলা চালাতে পারল, কেন ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বাণিজ্যের টোপ দিয়ে সম্ভাব্য যুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার দাবি করে চলেছেন; সময়ের এমন সন্ধিক্ষণে সেনা অভিযানে পহেলগাঁও হামলার মূল চক্রীর মৃত্যুসংবাদ সামনে এল! সরকারের পক্ষে একে কেউ হয়তো বলবেন, এটি সেনার পূর্বপরিকল্পিত অভিযান। সেনাবাহিনী নিজের গতিতেই চলেছে। কিন্তু উপত্যকায় সেনা কোন মুহূর্তে অভিযান চালাবে, সে বিষয়ে দিল্লীর উচ্চস্তরের নির্দেশ বা সম্মতি ছাড়া কিছুই হয় না- এ কথা প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষকেরা বিলক্ষণ জানেন। তা হলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, সংসদে বিতর্ক শুরু হতেই হঠাৎ এই অপারেশনের ফল প্রকাশ কি নিছক সমাপতন? নাকি এটি একটি কৌশলগত সময়চয়ন, যার লক্ষ্য বিরোধীদের তিরস্কারকে ব্যাকফুটে পাঠানো?
অপারেশন সিন্দুর নিয়ে বিরোধীদের অভিযোগ ছিল একাধিক স্তরে।সেই বিতর্কের মাঝখানে পহেলগাঁও অভিযানের সাফল্য তুলে ধরার মধ্য দিয়ে সরকার কার্যত একটি বার্তা দিতে চেয়েছে যে, নিশ্চুপ নয়, সরকার ‘কার্যকর’। সেনার অভিযানকেই সেই কার্যকারিতার প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করানো হলো। এমন অবস্থায় একটি বড় প্রশ্ন সামনে আসে- নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কি শুধু সামরিক সাফল্যে মাপা যায়? সংসদীয় স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং জনমতকে পাশ কাটিয়ে কি শুধু অস্ত্রের ভাষা দিয়েই গণতন্ত্রের কাঠামো রক্ষা করা যায়?সেনাবাহিনীর পরিশ্রম ও সাহস অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা কি আদৌ সমীচীন? দুই সমান্তরাল ঘটনার মধ্যে তাই একটি সুনির্দিষ্ট কার্যকারণ না থাকলেও, রাজনৈতিক বার্তাবাহকের ভূমিকায় এই সময়চয়নকে একেবারে উপেক্ষা করাও চলে না। সম্ভবত সরকার চাইছে, বিরোধীদের সরাসরি উত্তর না দিয়ে, ‘অ্যাকশন’ দেখিয়ে আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দিতে। কিন্তু গণতন্ত্রে শুধু বিজয় নয়, প্রশ্নেরও স্থান থাকা উচিত। নচেৎ প্রশ্ন তোলা হবে- ‘বন্দুক জবাব দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কথা বলবে কে?’ অপারেশন মহাদেবের এই সময়চয়ন নিছক কাকতালীয়, না কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রাজনৈতিক কৌশল? অপারেশন মহাদেবে পহেলগাঁও কাণ্ডের অন্যতম চক্রীকে নিকেশ করা যদি সরকারের তরফে কোনো নির্দিষ্ট বার্তা হয়ে থাকে, তবে এর পিছনে রয়েছে একাধিক স্তর,যেগুলি বিশ্লেষণ জরুরি।
সেনা অভিযান কি সরকারের জবাবদিহির বিকল্প হতে পারে? সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল যখন প্রশ্ন তোলে তখন উত্তর দেওয়াটাই দস্তুর। সে উত্তর রাজনৈতিক, কৌশলগত বা নৈতিক হতে পারে। কিন্তু তার বদলে সেনার বুলেটকে উত্তর হিসেবে তুলে ধরা কি গণতান্ত্রিক আচরণ? এতে বিরোধী প্রশ্নকে ‘দেশদ্রোহের ছায়া’য় ঠেলে দেওয়া হয়, যা রাজনীতির পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, সেনার সাফল্য-প্রশংসার কোনো ভাষাই যথেষ্ট নয়। সুলেমান শেখের মৃত্যু ভারতের নিরাপত্তার পক্ষেও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাতে কি সংসদের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা কমে যায়? ছাবিশজন নিরীহ প্রাণের মূল্যের কাছে প্রতিহিংসার চেয়ে জবাবদিহির মূল্য অনেক বেশি।
অতএব, ২৮ জুলাইয়ের দুই সমান্তরাল দৃশ্য, একদিকে গর্জনরত সংসদ, অন্যদিকে সেনা, আধা-সেনা, জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের যৌথ অভিযান; ভবিষ্যতের ভারতীয় রাজনীতিতে এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই দুই পরিসরের সংযোগ সরাসরি হলেও তাৎপর্য গভীর। সরকার ‘প্রতিক্রিয়া’ নয়, ‘প্রতিঘাত’ দিয়ে জবাব দিচ্ছে- এ এক নতুন কৌশল। কিন্তু এই কৌশল দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রের বুনোটকে কতটা মজবুত রাখবে, সে প্রশ্ন আপাতত খোলা থাক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *