August 2, 2025

নাগরিকত্বে টানাটানি!!

 নাগরিকত্বে টানাটানি!!

আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হঠাৎ করেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব ঘটল।এ নিয়ে চলছে চরম তোলপাড় দেশটির ঘরোয়া রাজনীতিতে। চিনের প্রেসিডেন্ট বা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নন, এমনকী আয়াতুল্লাহ আলি খামেইনিও নন, এদের চেয়েও বড় উদ্বেগ উৎকণ্ঠা আজ ট্রাম্পের সামনে তার ঘরের ভেতরে তৈরি হওয়া এক পরিস্থিতিতে। নিউইয়র্ক নগরের ডেমোক্র্যাট মেয়র প্রার্থী জোহরান মামদানির মার্কিন নাগরিকত্ব বাতিলের কথা উঠেছে। ট্রাম্প অনুরাগী পত্রপত্রিকায় এই ধরনের বিশ্লেষণ প্রকাশ হচ্ছে শুধু নয়, ট্রাম্প নিজের মুখেমানদানির নাগরিকত্ব নিয়ে কথা বলছেন। তার নাগরিকত্ব বিষয়টি বিবেচনা করার ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা।
অন্যদিকে, নিজের একসময়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইলন মাস্ক সম্পর্কে ট্রাম্প বলেছেন, তাঁকে ব্যবসা গুঁটিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে যেতে হতে পারে। সরকারী ব্যয় বাড়ানো ও করছাড়ের বিষয়ে একটি বিল যা ট্রাম্পের কথায়, বিগ বিউটিফুল বিল-ওইটাকে কেন্দ্র করেই মিত্র থেকে শত্রুতার মুখোমুখি অবস্থানে গিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছেন ট্রাম্প ও মাস্ক। জোহরান ও মাস্ক-কারোর জন্মই যুক্তরাষ্ট্রে নয়। দুজনই পরে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন এবং ন্যাচারালাইজেশনের মাধ্যমে মার্কিন নাগরিকত্ব পেয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন কি তাঁদের মার্কিন নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে? এই বিতর্ক এখন চরমে।
ন্যাচারালাইজেশনের মাধ্যমে আমেরিকার নাগরিকত্ব পেতে কোনো ব্যক্তির বয়স ১৮ বছরের বেশি হতে হবে এবং তাঁকে গ্রিন কার্ডধারী হিসেবে টানা পাঁচ বছর সেই দেশে বসবাস করতে হবে অথবা তিনি যদি মার্কিন নাগরিকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তবে তিন বছর বসবাস করলেই চলবে। জোহরান মামদানি ও ইলন মাস্কের নাগরিকত্ব সেই হিসাবেই রয়েছে। ৩৩ বছর বয়সি জোহরানের জন্ম উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায়, তাঁর মা-বাবা ভারতীয় বংশোদ্ভূত। সাত বছর বয়সে জোহরান নিউইয়র্কে চলে আসেন এবং ন্যাচারালাইজেশনের মাধ্যমে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পান। মাস্কের জন্ম ১৯৭১ সালে, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায়। তাঁর মা কানাডার নাগরিক, বাবা দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক। মাস্ক ১৭ বছর বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে কানাডায় যান, তিনি কানাডারও নাগরিক। পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে ১৯৯২ সালে মাস্ক আমেরিকা যান। ২০০২ সালে ন্যাচারালাইজেশনের মাধ্যমে মাস্ক মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করেন। এসব তথ্য ২০২৩ সালে সাংবাদিক ওয়াল্টার আইজ্যাকসনের লেখা মাস্কের জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০২৪ সালের অক্টোবরে ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইলন মাস্ক যথাযথ কর্ম অনুমোদন বা ওয়ার্ক অথরাইজেশন ছাড়াই আমেরিকায় কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। মাস্ক এই দাবি অস্বীকার করেছেন। জোহরান মামদানি একজন প্যালেস্টাইনপন্থী, ডেমোক্র্যাট ও কমিউনিস্ট। তার বিরুদ্ধে যেসব লেখালেখি হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হলো-নিউইয়র্কের মতো মহান শহরকে ধ্বংস করে দেবেন মামদানি। তাঁকে বিতাড়ন করা প্রয়োজন। রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা অ্যান্ডি ওগলস ওয়াশিংটন পোস্টে ওই প্রতিবেদন লিখেছেন। সে দিনই এক্সে এক পোস্টে মাস্ক লেখেন, আসলে আমি যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করার অনুমতি পেয়েই কাজ শুরু করেছি।
আরেকটি পোস্টে এই ধনকুবের লেখেন, তখন আমার জে-১ ভিসা ছিল, যা পরে এইচ-১ বি ভিসায় রূপান্তর করা হয়। আমেরিকায় বিদেশি শিক্ষার্থীদের জে- ১ ভিসা দেওয়া হয়।শিক্ষাগত বা সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য এই ভিসা দেওয়া হয়। আর এইচ-১ বি ভিসা হলো সাময়িকভাবে কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে থাকার অনুমতি। ট্রাম্প নিউইয়র্ক সিটির বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসের প্রতি নিজের সমর্থন প্রকাশ করেছেন। অ্যাডামসও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য। টেনেসি থেকে রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা অ্যান্ডি ওগলস গত ২৬ জুন অ্যাটর্নি জেনারেল প্যাম বন্ডিকে একটি চিঠি লেখেন। ওই চিঠিতে তিনি জোহরান মামদানির নাগরিকত্ব প্রত্যাহারের (ডিন্যাচারালাইজেশন) প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত কি না, তা তদন্ত করে দেখার জন্য বিচারবিভাগকে অনুরোধ করেন। বন্ডি যে চিঠি পাঠিয়েছেন, তার একটি প্রতিলিপি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পোস্ট করেছেন। ওগলস লিখেছেন, জোহরান মামদানি একজন ইহুদিবিরোধী, সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট। তিনি নিউইয়র্কের মতো মহান শহরকে ধ্বংস করে দেবেন। তাঁকে বিতাড়ন করা প্রয়োজন। বস্তুত এটি এই সময়ে ট্রাম্প এবং রিপাবলিকান পার্টিরও কথা।
এ কারণেই ওগলস জোহরানের নাগরিকত্ব বাতিলের (ডিন্যাচারালাইজেশন) প্রক্রিয়া শুরু হওয়া দেখতে চান বলে চিঠিতে উল্লেখ করেছেন।
ওগলস বলেন, জোহরান সন্ত্রাসবাদে তাঁর অর্থিক বা নৈতিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন করে বা ভ্রান্তভাবে উপস্থাপন করে মার্কিন নাগরিকত্ব অর্জন করে থাকতে পারেন- এর ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত। জোহরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে গিয়ে ওগলস সংবাদমাধ্যমের কয়েকটি প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যার মধ্যে নিউইয়র্ক পোস্টে প্রকাশিত একটি নিবন্ধও রয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, জোহরান মামদানি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার আগে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছিলেন।
সম্প্রতি মামদানি বলেছিলেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি আমাকে গ্রেপ্তার, নাগরিকত্ব বাতিল, আটককেন্দ্রে রাখা এবং দেশ থেকে বিতাড়িত করার হুমকি দিয়েছেন। এ হুমকি আমার কোনো আইন লঙ্ঘনের কারণে নয়; বরং আমি আইসিইকে আমাদের শহরে কোনো আতঙ্ক ছড়াতে দেব না বলেছি বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে। নিউইয়র্ক সিটির ডেমোক্র্যাট মেয়র প্রার্থী জোহরানের একটি র‍্যাপ গান ‘ফ্রি দ্য হোলি ল্যান্ড ফাইভ/মাই গাইজ’এর কথাও উল্লেখ করেছেন ওগলস। চিঠিতে ওগলস আরও লেখেন, স্বীকৃত বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হামাসকে সহায়তা করার দায়ে ২০০৮ সালে হোলি ল্যান্ড ফাউন্ডেশনকে সাজা দেওয়া হয়। এই ফাউন্ডেশনের দণ্ডিত নেতাদের প্রকাশ্যে ‘মাই গাইজ’ বলে প্রশংসা করা একটি গুরুতর প্রশ্ন তোলে। সেটি হচ্ছে- ন্যাচারালাইজেশন প্রক্রিয়ার সময় জোহরান মামদানি কোনো ধরনের সংযোগ বা সহানুভূতির বিষয় গোপন করে গেছেন কি না। জোহরান সাম্প্রতিক সময়ে ‘গ্লোবালাইজ দ্য ইনতিফাদা’- এই স্লোগান প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ পেয়েও তা প্রত্যাখ্যান করেননি। উগ্র ইহুদিরা অভিযোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বজুড়ে সাধারণ নাগরিকদের ওপর সহিংস হামলা ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে এই স্লোগানে। এই কথা ঠিক যে অতীতেও মার্কিন মুলুকে নাগরিকত্ব বাতিলের নজির আছে। কিন্তু যে যে কারণে এবং প্রেক্ষাপটে বাতিল হয়েছিল তার
কোনওটাই নেই ইলন মাস্ক বা মামদানির ক্ষেত্রে। ফলত এই দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ট্রাম্পের খোলামেলা বক্তব্য আমেরিকার নাগরিকদের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে। মামদানি জোহরানের রাজনৈতিক উত্থান যেমন মার্কিনবাসীদের জন্য অভাবনীয় তেমনি ধনকুবের ইলন মাস্কের সঙ্গে ট্রাম্পের দূরত্ব সেই দেশের মানুষের জন্য এক চমকপ্রদ ঘটনা এই মুহূর্তে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *