ডায়াবেটিস ও ত্বকের সমস্যা-কারণ,প্রতিকার ও সচেতনতা।।

ভূমিকা:-ডায়াবেটিস শুধু রক্ত
গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি করে না, বরং শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে তার প্রভাব ফেলে। একাধিক জটিলতার মধ্যে ত্বকের সমস্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রায়শই উপেক্ষিত অংশ। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে হাত-পা ও অন্যান্য বহিঃঅঙ্গগুলিতে চক্রাকার গাঢ় দাগ, অন্ধকার হয়ে যাওয়া, খুসকি ও চুলকানি ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়। এই উপসর্গগুলো শুধুমাত্র অস্বস্তিকর নয়, এগুলি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকার ও শারীরিক জটিলতার একটি সংকেত হতে পারে। এই প্রবন্ধে আমরা ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে ত্বকের এই বিশেষ উপসর্গগুলি কেন হয়, কীভাবে এগুলিকে সামলানো যায় এবং কীভাবে সচেতনতা বাড়িয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব-তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।
ত্বকের গাঢ় দাগ ও চক্রাকার র্যাশ:কী ও কেন?১. Acanthosis Nigricans (অ্যাকান্থোসিস নিগ্রিকান্স)এটি একটি সাধারণ চর্মরোগ যা ডায়াবেটিস আক্রান্তদের ঘাড়, বগল, কনুই, হাঁটু এবং আঙুলের গিঁটের কাছে গাঢ়, মোটা ও মখমলির মতো দাগের আকারে দেখা দেয়।
কারণ: ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের ফলে ইনসুলিনের অতিরিক্ত সঞ্চার ত্বকের কোষে অতিরিক্ত বৃদ্ধি ঘটায়, ফলে গাঢ় রং ধারণ করে।২. Necrobiosis Lipoid-ica Diabeticorum
(এনইপ্রোবায়োসিস লাইপয়ডিকা) এটি একটি বিরল কিন্তু জটিল ত্বকের সমস্যা, যা মূলত পায়ে (শিন এরিয়া) চক্রাকার লালচে বা বাদামী দাগ হিসাবে শুরু হয়, ধীরে ধীরে দাগের মধ্যভাগ পাতলা ও হলদেটে হয়ে পড়ে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা রং পরিবর্তন করে।
কারণ: ক্ষুদ্র রক্তনালীর প্রদাহ ও ক্ষতি।৩. Diabetic Dermopathy (ডায়াবেটিক ডার্মোপ্যাথি) এটি ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ ত্বক সমস্যা, বিশেষত বয়স্ক পুরুষদের মধ্যে। পায়ের উপরের দিকে গাঢ় বাদামি, গোলাকৃতি ও কিছুটা ডুবে যাওয়া দাগ দেখা যায়, যা ব্যথাহীন ও অচুলকানিযুক্ত হয়।8. Tinea corporis ও অন্যান্য ছত্রাক সংক্রমণ চক্রাকার, উঁচু প্রান্তবিশিষ্ট, চুলকানিযুক্ত লাল র্যাশ – যা সাধারণত ‘ringworm’ নামে পরিচিত – ডায়াবেটিক রোগীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
কারণ: রক্তে উচ্চ শর্করার মাত্রা ছত্রাকের বৃদ্ধি সহজ করে তোলে।
এই ত্বক সমস্যাগুলির মূল কারণ কী?এই ত্বক সমস্যাগুলির মূল কারণ কী?১. উচ্চ রক্তে গ্লুকোজ: রক্তে শর্করার উচ্চ মাত্রা ত্বকের স্বাভাবিক সুরক্ষা ক্ষমতা হ্রাস করে, ফলে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক সহজেই সংক্রমণ ঘটাতে পারে।২. স্নায়ু ও রক্তনালীর ক্ষয়:দীর্ঘমেয়াদী ডায়াবেটিস স্নায়ু ও ক্ষুদ্র রক্তনালীগুলির ক্ষতি করে, ফলে ত্বকে রক্তপ্রবাহ কমে ও পুনর্জন্ম ধীর হয়।৩. ইমিউন সিস্টেম দুর্বল হওয়া:ডায়াবেটিস রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কিছুটা কমে যাওয়ায় সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে।৪.ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স: ইনসুলিন অতিরিক্ত পরিমাণে ত্বকে কোষের বর্ধন ঘটিয়ে দাগ সৃষ্টি করে।
ত্বকের যত্ন ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা১. গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখা:-সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে রাখা।নিয়মিত পরীক্ষা করুন এবং লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাখুন (<7%)।২. প্রতিদিন ত্বক পরীক্ষা করা:-প্রতিদিন হাত, পা, আঙুলের ফাঁক ও অন্যান্য অংশে কোনও রকম দাগ, লালচে ভাব বা ফোসকা হয়েছে কি না পরীক্ষা করুন।বিশেষ করে যারা স্নায়বিক সমস্যা(ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি) ভুগছেন, তাদের পায়ে ছোট ক্ষত চোখ এড়িয়ে যেতে পারে।৩. ত্বক পরিষ্কার ও শুষ্ক রাখা প্রতিদিন গোসলের পর ত্বক ভাল করে শুকিয়ে নিন, বিশেষত আঙুলের ফাঁকে, বগল ও কোমরের কাছে। ছত্রাক সংক্রমণ প্রতিরোধে অ্যান্টিফাঙ্গাল পাউডার বা ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে (যেমন: ক্লোট্রিমাজল, মিকোনাজল) চিকিৎসকের পরামর্শে।৪. ত্বক ময়েশ্চারাইজ রাখা শুষ্ক ত্বকে ফাটল ধরে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে, তাই প্রতিদিন ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করুন।গ্লিসারিন বা ইউরিয়া-সমৃদ্ধ ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।৫. সূর্যরশ্মি ও ধূলাবালি থেকে রক্ষা করা:-বাইরে বের হলে হাত-পা ঢেকে রাখুন, সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।অতিরিক্ত রোদে থাকা চর্মরোগ বাড়াতে পারে।৬. নখ ও ত্বক ঠিকঠাক কাটা ও পরিষ্কার রাখা:-পায়ের নখ কাটার সময় সতর্কতা অবলম্বন করুন। হঠাৎ কেটে ফেলা থেকে সংক্রমণ হতে পারে। ঘটাতে পারে।
চিকিৎসা কবে নেওয়া উচিত?চিকিৎসকের পরামর্শ অবিলম্বে
নেওয়া উচিত যদি:ত্বকে হঠাৎ গাঢ় দাগ দেখা দেয় যা বাড়ছে চক্রাকার দাগগুলি চুলকায় বা পুঁজ বেরোয় র্যাশ থেকে রক্তপাত বা ফোসকা দেখা যায় ক্ষত শুকোচ্ছে না বা তীব্র ব্যথা হচ্ছে
পায়ে ফোড়া বা গ্যাংগ্রিনের লক্ষণ দেখা দেয় চিকিৎসা পদ্ধতি (Dermatolog-ical Management)
Acanthosis Nigricans:সাধারণত ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স নিয়ন্ত্রণ করলেই দাগ হালকা হয়। প্রয়োজনে ডার্মাটোলজিস্ট treti-noin cream বা chemical exfoliants ব্যবহার করতে পারেন।
Tinea বা ছত্রাক সংক্রমণ:স্থানীয় অ্যান্টিফাঙ্গাল (Clotrima-zole, Terbinafine)। গুরুতর হলে মুখে খাওয়ার ওষুধ যেমন fluconazole / itra-conazole দেওয়া হয়।
Diabetic Dermopathy:আলাদা করে চিকিৎসা প্রয়োজন পড়ে না, তবে রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
Necrobiosis Lipoidica:Corticosteroid ক্রিম, বা ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়।
চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী, রোগীকে ধৈর্য ধরতে হয়।প্রাকৃতিক প্রতিকার ও ঘরোয়া টিপসদুধ ও হলুদের প্যাক: দুধের ল্যাকটিক অ্যাসিড ত্বক উজ্জ্বল করে, হলুদের অ্যান্টিসেপটিক গুণ আছে।
অ্যালোভেরা জেল: প্রতিদিন ব্যবহারে চুলকানি ও ত্বকের জ্বালাভাব কমে।
মেথি ও নিমপাতা বাটা: ছত্রাক সংক্রমণে উপকারী।তবে মনে রাখবেন, ঘরোয়া প্রতিকার শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ীই গ্রহণযোগ্য।
উপসংহার
ডায়াবেটিসে ত্বকের যত্ন কোনও বিলাসিতা নয়, এটি রোগ নিয়ন্ত্রণেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অন্ধকার দাগ, চক্রাকার র্যাশ ও অন্যান্য উপসর্গগুলো শরীরের ভেতরের ভারসাম্যহীনতার প্রতিফলন হতে পারে। নিয়মিত রক্তে শর্করার মান পরীক্ষা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত ঘুম, হালকা ব্যায়াম এবং নিয়মিত চিকিৎসক পরিদর্শন-এই পাঁচটি বিষয়েই ত্বক থাকবে সুস্থ ও সুন্দর। ত্বককে অবহেলা নয়, নজরে রাখুন। কারণ ত্বক অনেক সময় রোগের নিঃশব্দ সংকেত দেয়।