ট্রাম্প ও ভারত পাকিস্তান!!

দক্ষিণ এশিয়ার এশিয়ার দুই যুযুধান প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানকে নিয়ে নিত্যনতুন ঘুঁটির চাল দিয়ে অন্যরকম কূটনৈতিক খেলায় মেতেছে ডোনাল্ড ট্রাম্প।প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের দৃশ্যত উন্নতি এবং ওয়াশিংটন-নয়াদিল্লী সম্পর্কের অবনতি নিয়ে পাকিস্তান ব্যাপক রকম উদ্দীপ্ত দেখা যাচ্ছে। কিন্তু উদ্দীপনার পাটাতন কতটা শক্তিশালী এবং টেকসই এই নিয়ে সন্দেহ আছে বরাবরের মতো। আমেরিকা যে হিসাব নিকাশে দুই দেশকে সামলানোর চেষ্টা করে তা এক ধরনের খেলানো মানে বঁড়শির ছিপে মাছ ধরার মতো, অতীতে সেই প্রমাণ মিলেছে বারবার। কূটনৈতিক বিশ্লেষক মহল এরই মধ্যে আমেরিকা-পাকিস্তান সম্পর্কের পরিবর্তনকে ‘জোটের পুনর্বিন্যাস’ এবং ‘দিক পরিবর্তন’ বলতে শুরু করেছেন। কিন্তু আদৌ কি তাই?জোটের ‘পুনর্বিন্যাস’ যদি হয় চিনের কাছ থেকে পাকিস্তানকে সরিয়ে আনা, তাহলে এই বিশ্লেষকেরা সম্ভবত ঠিক বলছেন না। কারণ পাকিস্তান চিনের কাছ থেকে এইভাবে সরে আসবে না কোন কারণেই।
চিন পাকিস্তানের জন্য বরাবর নির্ভরযোগ্য অংশীদার ও বন্ধু।পাকিস্তান বহু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক প্রয়োজন ও পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য চিনের উপর নির্ভরশীল।ইসলামাবাদের এই নির্ভরশীলতা দিনে দিনে বাড়ছে। এছাড়া চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো পাকিস্তান। এরচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ক্রমশ আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠা দিল্লীর হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার এবং এই সরকারের পরিচালক শক্তি ভারতে নিরলসভাবে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব উসকে দিয়ে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের উচ্চাকাঙক্ষাকে ঠেকাতে হলে পারমাণবিক প্রতিরোধী ব্যবস্থার সঙ্গে সামরিক সরঞ্জামও প্রয়োজন। যা পাকিস্তানকে কেবল চিনই দিতে পারে ও দিয়ে থাকে। তবে ট্রাম্পের কূটনীতিতে পাকিস্তানের জন্য কিছু সুযোগ এসেছে, একটা খেলার সুযোগ। মানে একজন জিতলে আরেকজন হারবে।
আমেরিকা যেমন পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ‘হয় আমার পক্ষে, না হয় আমার বিরুদ্ধে’ এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখে থাকে, চিন এ রকমভাবে দেখে না। চিনের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি সুক্ষ্ম ও বাস্তববাদী ও বাণিজ্যিক।এর কারণ হলো চিন এখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাণিজ্যকে মূল মনোযোগের কেন্দ্রে রেখেছে।পশ্চিম বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো প্রায়ই চিনের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকে। আবার এটাও ঠিক, গাজায় যে জাতিগত নির্মূল যজ্ঞ চলছে, তাতে প্রায় সমগ্র পশ্চিমি ‘গণতন্ত্র’ ইজরায়েলের দুষ্কর্মের দোসর। চিন সেখানে সেই ভূমিকায় নেই। ট্রাম্প উন্মাদনায় পাকিস্তান দুইটি সঠিক ঘুঁটি খেলেছে। প্রথমত, সঠিকভাবে ট্রাম্পের আত্মমুগ্ধতাকে গুরুত্ব দিয়েছে। ট্রাম্পের নাম শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেছে। ২০২১ সালের আগষ্টে কাবুল বিমানবন্দরের ‘অ্যাবি গেট’ বোমা হামলার একজন অভিযুক্তকে দ্রুত গ্রেপ্তার ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যর্পণ করেছে। এতে ‘কঠোর নেতা’ হিসেবে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি শক্তিশালী হয়েছে। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যখন তড়িঘড়ি করে কাবুল ত্যাগ করছিল, তখন ওই হামলায় ১৩ জন মার্কিন সেনা এবং ২০০ আফগান নিহত হয়েছিলেন। সেই দোষী ব্যক্তিকে আমেরিকার হাতে তুলে দিয়েছে ইসলামাবাদ।
চিনকে মোকাবিলার জন্য আমেরিকা বরাবর ভারতকে সামনে ঠেলে দিচ্ছে। ভারত এখন কোয়াডেরও সদস্য। আমেরিকার নেতৃত্বে এই জোটের অন্য দুই সদস্য হলো অস্ট্রেলিয়া ও জাপান। এ কারণেই ব্রিকসে ভারতের সদস্যপদকে এশিয়ায় পশ্চিমি কৌশলগত কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ভারত এমন একটি পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করছে,যেখানে নিজেদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজকের দিনে ভারতকে এখন এক পক্ষ বেছে নিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। গত মে মাসে ভারত যখন পহেলগাঁও হামলার জবাবে পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটিতে হামলা চালায় সে সময় উভয় পক্ষকে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানায় আমেরিকা। মার্কিনি সংবাদমাধ্যমের দাবি, ইসলামাবাদ সে সময়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানায় এবং আত্মমুগ্ধ নেতা ট্রাম্পকে তপ্ত করে। ট্রাম্প নিজেকে শান্তির দূত হিসেবে উপস্থাপন করতে কখনো ক্লান্ত হন না। তার জন্য নোবেল দাবি করে পাকিস্তান।
অন্যদিকে মনে করা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এমন দুটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন যা ট্রাম্পকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। প্রথমটি হলো ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনি প্রচারে ছিলেন, তখন মোদি তার আমেরিকা সফরে ছিলেন ও ট্রাম্পের সঙ্গে পূর্ব প্রস্তাবিত একটি বৈঠক বাতিল করেছিলেন। এটা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে ট্রাম্পের বিশাল অহংবোধে নির্ঘাত আঘাত করবে। ভারতের জন্য আরেকটি অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটে মে মাসে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণের সময়। সংঘাত যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় তার জন্য মার্কিন নেতারা টেলিফোনে যোগাযোগ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই দেশই হোয়াইট হাউসকে জানায়, তারা উত্তেজনা প্রশমন করবে, কিন্ত ভারত থামেনি।
ধারণা করা হয় ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হওয়ার কারণ হলো ট্রাম্প ধরে নিয়েছেন ভারত মুখে এক কথা বললেও উল্টোটা করে আমেরিকাকে অবজ্ঞা করেছে। যদিও ভারত শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সাড়া দেয় এবং ট্রাম্প একটি যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলে তা মেনে নিতে সম্মত হয়, কিন্তু ততক্ষণে পারস্পরিক সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এ ঘটনাক্রম আমেরিকা ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক অবনতি ঘটিয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এটা ভাবা শিশুতোষ হবে যে বিশ্বশক্তিগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক এ রকম ছোটখাটো ইস্যুর উপর নির্ভর করে থাকে। আমেরিকা-ভারত সম্পর্কের মধ্যে প্রধান উত্তেজনার উৎস হলো ভারতের ব্রিকসের সদস্যপদ। এই জোটে রাশিয়া, চিন, ব্রাজিল, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা-সহ কয়েকটি ছোট দেশ মিলে একটি বাণিজ্যিক ব্লক গঠন করেছে। ব্রিকস একটি নতুন মুদ্রা চালুর চিন্তা করছে, যার মাধ্যমে মার্কিন ডলার ছাড়াই বাণিজ্য করা যাবে। যদি এমনটি বাস্তবে ঘটে, তাহলে ডলারের প্রাধান্য হ্রাস পাবে এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এড়াতে একটি বিকল্প লেনদেনের পদ্ধতি পাবে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশগুলি। নতুন এই মুদ্রাকে অনেকে অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করলেও আমেরিকা এই বিষয় সহ্য করতে পারছে না।