উত্তরাখণ্ডে ভয়াবহ ভূমিধসে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সুড়ঙ্গে বন্দি ১৯ কর্মী!!
ট্রাম্পের শক্তিশেল!!

পাশাপাশি বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে ভারত আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক যে কতটা জটিল ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ, তা এখন চোখে পড়ার মতো।বাণিজ্যের দেবতা গণেশ পুজোর দিন ভারতের রপ্তানি বাণিজ্যের উপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ ট্যারিফ নামক শক্তিশেল শুধু কূটনৈতিক একটি ইঙ্গিত নয়; এটি ভারতের অর্থনীতির জন্য একটি ভীতিকর আঘাত, যে ভীতির প্রকৃত ভয়াবহতা এখনও অজানা। এটি দেশের রপ্তানি শিল্প, কৃষক, উৎপাদক এবং লাখ লাখ সাধারণ মানুষের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে চলেছে। টেক্সটাইল, জুয়েলারি রত্ন-অলঙ্কার, সামুদ্রিক খাদ্য, ইলেকট্রনিক্স, ইঞ্জিনীয়ারিং; রপ্তানি-নির্ভর প্রায় সমস্ত দেশীয় শিল্পক্ষেত্র ঝুঁকির মুখে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ট্যারিফ ভারতের রপ্তানি ৫০-৫৫ শতাংশকে প্রভাবিত করতে চলেছে, অর্থের অঙ্কে যা ৪৭ বিলিয়ন ডলার।
তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, সরকারের দৃষ্টি অন্যদিকে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ী ও দোকানদারদের পরামর্শ দিয়েছেন, দোকানের বাইরে ‘স্বদেশি বোর্ড’ টাঙান। লাখ লাখ মানুষের চাকরি, কৃষকের ঘাম, শিল্পের উৎপাদন- সবই ঝুঁকির মধ্যে, অথচ আমাদের দৃষ্টি ঘোরানো হচ্ছে শুধু বোর্ড ও স্লোগান দিয়ে। এই পরিস্থিতিতে কোনও প্রতীকী স্টান্টের বদলে সরকারের প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট নীতি, আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। পরাধীন ভারতে স্বদেশি আন্দোলন কখনও কেবল স্লোগানের জন্য ছিল না। মহাত্মা গান্ধীর বিদেশি পণ্য বর্জন ছিল দেশপ্রেমের অভিন্ন অংশ। সেই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল দেশীয় উৎপাদন ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। আজকের বোর্ড ঝোলানো স্লোগানের মধ্যে কি সেই স্বাধীনতার চেতনা আছে? প্রশ্ন তৈরি হয়।
রাশিয়া থেকে তেল কেনার ‘অপরাধে’ ভারত কিন্তু একা ‘অভিযুক্ত’ নয়। গত পাঁচ বছরে শি জিনপিঙের চিন তাদের প্রয়োজনের ৪৭ শতাংশ কাঁচা তেল এবং ৪৪ শতাংশ কয়লা আমদানি করেছে রাশিয়া থেকে, যেখানে রাশিয়া থেকে ভারতের আমদানি ৩৮ শতাংশ তেল এবং ২০ শতাংশ কয়লা। কিন্তু বেজিংয়ের কেশাগ্র স্পর্শ করার হিম্মত দেখাতে পারেননি ট্রাম্প, অন্যদিকে নরম মাটি বলে ভারতের উপর ক্রোধাগ্নি বর্ষণ করে চলেছেন। তবু ভারতের তরফে পাল্টা একটি বিবৃতিও আসেনি, কীভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা হবে তা জানাতেও নীরবতা বজায় রাখা হয়েছে।
রত্ন-অলঙ্কার শিল্পের উদাহরণ দেখলেই বোঝা যায়, গুজরাটের ‘হিরানগরী’ বলে খ্যাত সুরাটে বিশ্বের আশি শতাংশ হিরা কাটা ও পালিশের কাজ হয়। এই সুবৃহৎ বাজারে কয়েক লক্ষাধিক চাকরি হারানোর ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। সামুদ্রিক খাদ্যের ক্ষেত্রেও ক্ষতির সম্ভাবনা বিরাট। চিনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত চললেও ভারত চিনা পণ্যের উপর নির্ভরতা কমাতে পারেনি, বরং বেড়েই চলেছে। এই বাস্তবতা দেখায়,ট্যারিফ মোকাবিলায় কৌশলহীন থাকা কতটা বিপজ্জনক।
একদিকে প্রধানমন্ত্রী গুজরাটের সভামঞ্চ থেকে দোকানদারদের ‘স্বদেশি বোর্ড’ টাঙানোর পরামর্শ দিচ্ছেন, অথচ অন্যদিকে তার সরকার আমেরিকার জেনারেল ইলেকট্রিক (জিই) কোম্পানি থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের ফাইটার জেট কেনার তোড়জোড় করছে। দেশের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এই চুক্তির সঙ্গে স্বদেশি আন্দোলনের প্রতীকী স্টান্ট মিলিয়ে দেখানো হচ্ছে। বোর্ড ঝোলানো, স্লোগান – এই ভিজ্যুয়াল স্টান্ট কি রপ্তানি শিল্প, কৃষক বা শ্রমিকদের বাঁচাতে পারবে? উত্তর স্পষ্ট: না। পরিস্থিতি আরও গুরুতর। ট্রাম্পের ট্যারিফে কৃষক, উৎপাদক এবং রপ্তানির উপর বোঝা বাড়ছে, কিন্তু সরকারের দৃষ্টি দোকানদারের বোর্ডে। লাখ লাখ মানুষের চাকরি হারানোর সম্ভাবনা, শিল্পের ক্ষতি- সবই গোপন। ট্রাম্পের শক্তিশেলের মোকাবিলায় ভারতের সব দোকানের সামনে ‘স্বদেশি’ বোর্ড ঝোলানো কি আদৌ কোনও বিবেচক পদক্ষেপ? কৃষক, উৎপাদক এবং শ্রমিকের ক্ষতি কোথায় আচ্ছাদিত হচ্ছে? স্বদেশি বোর্ড শুধু স্টান্ট, বাস্তব সমাধান নয়, এটা বোঝার জন্য কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। দেশীয় শিল্প রক্ষা করার জন্য সরকারের উচিত সুনির্দিষ্ট নীতি, আন্তর্জাতিক লবিং এবং শিল্প-উৎপাদনের কার্যকর সমাধান নেওয়া।
সবশেষে বলার, ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ ট্যারিফ ভারতের জন্য শুধু একটি অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি দেশের রপ্তানি, শিল্প, কৃষি এবং সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য হুঁশিয়ারি সংকেত। শুধুমাত্র শ্লোগান বা বোর্ড ঝোলানো দিয়ে এই ঝুঁকি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। বোর্ড ঝোলানো বা স্লোগান লেখা একটাই কাজ করে – চোখ ধাঁধানো শোভাবর্ধন করে দৃশ্য রাজনীতি রচনা করা, বাস্তব সমাধান নয়। তাই সময় এসেছে চোখ খুলে, মাথা ঠাণ্ডা করে এবং দেশের নাগরিক ও শিল্পের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়ার। দেশের অর্থনীতি বাঁচানোর দায়িত্ব সরকারের হাতে।