October 21, 2025

জীবন বাঁচিয়ে উন্নয়ন!!

 জীবন বাঁচিয়ে উন্নয়ন!!

ভারতের রাস্তাঘাট আজ ভয়ঙ্কর মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হচ্ছে।আমরা যত উন্নয়ন, স্মার্ট সিটি, এক্সপ্রেসওয়ে, সড়ক প্রকল্পের কথা বলি না কেন, বাস্তবের পরিসংখ্যান কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো। প্রতি তিন মিনিটে একজন ভারতীয় পথ দুর্ঘটনার বলি হন!কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকের ২০২৩ সালের রিপোর্ট বলছে- সেই বছর দেশে মোট ৪ লক্ষ ৮০হাজার ৫৮৩ টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাতে প্রাণ হারিয়েছেন ১ লক্ষ ৬৮ হাজারেরও বেশি মানুষ।
অর্থাৎ, এক বছরে হারিয়ে গিয়েছে একেকটি ছোট শহরের সমান মানুষ। প্রতি দিন গড়ে ৪৬০ টি মৃত্যু- যা এক একটি যুদ্ধের মৃত্যুহারের সমান’!এই ভয়াবহ বাস্তবতাকে সামনে রেখে অবশেষে নড়েচড়ে বসেছে শীর্ষ আদালত।
মঙ্গলবার বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এক ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণে জানায়- সব কিছুই নির্ভর করছে বাস্তবে নির্দেশিকার প্রয়োগের উপর। আদালতের মতে, শুধু নিয়ম বানালেই হবে না, তা কার্যকর না হলে আইন কাগজে থেকে যাবে, আর মানুষ মরতে থাকবে রাস্তায়।
সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট নির্দেশে দিয়েছে- সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে ছয় মাসের মধ্যে ‘মোটর ভেহিকেলস অ্যাক্ট,১৯৮৮,এর ১২৮ (১) (এ) ও ২১০ (বি) ধারার অধীনে নিয়ম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
একই সঙ্গে আদালত জানিয়ে দিয়েছে, জাতীয় সড়ক ছাড়াও অন্যান্য সব রাস্তায় নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের মান বাড়াতে হবে এবং যানবাহন ও পথচারীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
এই নির্দেশের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভারতের সড়কব্যবস্থার দীর্ঘকালীন ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি।
বছরের পর বছর ধরে কেন্দ্রীয়ও রাজ্য সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে রাস্তা তৈরিতে।কিন্তু সেই রাস্তা যদি মৃত্যুর পথ হয়ে ওঠে, তবে সেই উন্নয়নের মূল্য কী?
দেশের বহু রাজ্যে রাস্তার নকশা ভুল, গর্তে ভরা রাস্তা, আলোহীন মোড়, অপরিকল্পিত ইউ-টার্ন, বেআইনি পার্কিং, রাস্তার ধারে হকারদের ভিড়-সব মিলে সাধারণ নাগরিকের জীবন ঝুঁকি মুখে।
শুধু তাই নয়, ট্রাফিক আইন মানার ক্ষেত্রে নাগরিকদের দায়িত্ববোধও ভয়াবহভাবে শিথিল।হেলমেট পরা বা সিটবেল্ট বাঁধা যেন এখনও অনেকের কাছে অপশনাল!মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালানো, লেন ভাঙা, ওভারটেকের প্রতিযোগিতা- সব মিলিয়ে এক অরাজক চিত্র।ফলাফল-মৃত্যুর মিছিল।শহর ও উপশহরের দ্রুত সম্প্রসারণ হয়েছে, কিন্তু রাস্তাঘাট ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। অনেক জায়গায় রাস্তা
নির্মাণের মান এত নিম্নমানের যে কয়েক মাসের মধ্যেই তা ভেঙে পড়ে। প্রশাসনিক দুর্নীতি ও উদাসীনতা এই সমস্যাকে আরও তীব্র করে তুলেছে। বেশিরভাগ রাজ্যে ‘রোড সেফটি কাউন্সিল’ বা নিরাপত্তা সেল শুধু নামেই আছে, কাজের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা প্রায় শূন্য।
পথ নিরাপত্তা কেবল আইনের বিষয় নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক সংস্কৃতি।
স্কুল থেকে শুরু করে কর্মস্থল-সব জায়গায় ট্রাফিক সচেতনতা শিক্ষার অংশ হওয়া দরকার। নিয়মিত প্রচার, হোর্ডিং, মিডিয়া ক্যাম্পেইন, এমনকী সিনেমা ও ওয়েব সিরিজেও এই বার্তা থাকা উচিত। কারণ, যতদিন না জনগণের মানসিকতা বদলাবে, আইন একা কিছু করতে পারবে না।আমরা রাস্তায় তাড়াহুড়ো করি, নিয়ম ভাঙি, ভাবি- আমার কিছু হবে
না।কিন্তু সেই অবহেলাই এক মুহূর্তে কেড়ে নেয় প্রাণ, ভেঙে দেয় পরিবার, ধ্বংস করে স্বপ্ন। প্রতি দুঘটনার পেছনে শুধু এক মৃত্যুই নয়- আছে এক মায়ের কান্না, এক সন্তানের অনাথ হওয়া, এক সংসারের ভাঙন।এর থেকে সমাধানের পথ হল,রাস্তা নির্মাণে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হবে এবং প্রতি বছর মান নিয়ন্ত্রণ অডিট বাধ্যতামূলক করতে হবে।দ্বিতীয়ত, সড়ক নিরাপত্তা তহবিল গঠন করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির পুনর্বাসন ও পুনরুজ্জীবনে অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে।
তৃতীয়ত, নাগরিক সচেতনতা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় সমন্বয় করতে হবে যাতে আইনভঙ্গ করলে জরিমানা শুধু অর্থদণ্ড নয়, বরং শিক্ষামূলক হয় (যেমন পুনরায় প্রশিক্ষণ)।চতুর্থত, ট্রাফিক পুলিশকে আধুনিক প্রযুক্তি ও নজরদারি সরঞ্জাম দিতে হবে, যাতে নিয়ম ভাঙা ধরা যায় তৎক্ষণাৎ।
শেষ কথা হল, সুপ্রিম কোর্ট এবার স্পষ্ট করে দিয়েছে- ‘আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ-নেই- এই সংস্কৃতি চলবে না। প্রশাসন যদি আবারও সময়ক্ষেপণ করে, তবে এই রক্তক্ষয়ী চিত্র বদলাবে না।দেশের উন্নয়ন কেবল সেতু বা এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে হয় না-হয় মানুষের জীবন বাঁচিয়ে।রাস্তা যেন আর মৃত্যুর ফাঁদ না হয়- এটাই এখন আমাদের সবার দায়, সবার লড়াই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *