চেক জালিয়াতির ভবিষ্যৎ!

সম্ভবত ত্রিপুরার ইতিহাসে এর আগে এত বড় চেক জালিয়াতির ঘটনা আর ঘটেনি।টাকার পরিমাণও নেহাত কম নয়।১৬ কোটি ৩৮ লক্ষ টাকার উপরে। আগরতলার পুর নিগমের অন্তর্গত পূর্ত বিভাগের ডিভিশন-টু এর সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের হেপাজতে থাকা চেক জালিয়াতি (ক্লোন) করে এই বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যাঙ্ক থেকে হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারকরা। এই চাঞ্চল্যকর ঘটনার খবর প্রকাশ্যে আসতেই জনমনে ব্যাপক উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। কেননা, ত্রিপুরা একটি ছোট রাজ্য। সেই হিসেবে এই নজিরবিহীন চেক জালিয়াতি কাণ্ডকে কোনওভাবেই হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। বরং পুরো ঘটনাটি অত্যন্ত উদ্বেগের। যতটুকু খবর নিয়ে জানা গেছে, রাজ্যের ইতিহাসে এত বড় জালিয়াতি এর আগে ঘটেনি। কিন্তু এই ঘটনা যতটা না উদ্বেগের তার চাইতে আরও কয়েকগুণ উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে রাজ্য সরকার, পুর নিগমের ভূমিকা! ইতিমধ্যেই এই ভয়ানক ঘটনায় রাজ্য সরকার ও আগরতলা পুর নিগমের ভূমিকায় জনমনে একাধিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। শুধু তাই নয়, সরকার ও নিগমের এই রহস্যজনক ভূমিকায় জনমনে বড় ধরনের সন্দেহ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে যে, রাজ্য সরকার ও পুর নিগম এই চাঞ্চল্যকর চেক জালিয়াতির ঘটনাটি কোনও না কোনওভাবে ধামাচাপা দিতে চাইছে। এই ঘটনার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত তদন্তের বিষয়ে যা যা বিষয় লক্ষ্য করা গেছে, তাতে জনমনে এই ধারণাই স্পষ্ট হচ্ছে।সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে সরকার এই চাঞ্চল্যকর ঘটনায় প্রকৃত দোষীদের আড়াল করতে চাইছে। এই ক্ষেত্রে পুলিশকে অযথা নিশানা করে বা পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার আঙুল তুলে লাভ নেই বলে মনে করছেন অনেকেই। কেননা, পুলিশ সরকারের অঙ্গুলি হেলনেই চলে। সরকার যা বলবে, যেভাবে বলবে, যেমনভাবে নির্দেশ দেবে পুলিশকে সেই ভাবেই কাজ করতে হয় এবং হবে। এনিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ পুরো টাকা ফেরত দিয়ে দেবে বলেই কি, ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে? ব্যাঙ্ক তো টাকা ফেরত দিতে বাধ্য। এখানে ব্যাঙ্কের কোনও মহানুভবতা নেই। ব্যাঙ্ক আমানত সুরক্ষিত রাখতে পারেনি। এটা ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের দায়। টাকা তাদের ফিরত দিতেই হতো।
এখন মূল বিষয় হচ্ছে, এত বড় জালিয়াতির পিছনে যারা যুক্ত, তারা কোন্ জাদুকাঠির স্পর্শে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে? ইউকো ব্যাঙ্কের ধৃত ক্যাশিয়ার একা শ্রীময়ীর পক্ষে যে এতবড় আর্থিক জালিয়াতি করা সম্ভব নয়, সেটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। অনেকে বলছেন, আসল অপরাধীদের আড়াল করতে শ্রীময়ীকে বলির হাড়িকাঠে তুলে দেওয়া হয়েছে। সব থেকে বিস্ময়জনক ঘটনা হলো, পুলিশ যখন অভিযোগ পেয়ে প্রথম এই চাঞ্চল্যকর চেক জালিয়াতির তদন্তে নামে, তখনই অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে পুলিশের হাতে চলে এসেছিল। পুলিশ তদন্তে অনেকদূর এগিয়েও যায়। শুধু তাই নয়, হাতিয়ে নেওয়া টাকার মধ্যে পুলিশ প্রায় সাত কোটি টাকা উদ্ধার করতেও সক্ষম হয়। কিন্তু এরপরই পুরো তদন্ত অন্যদিকে মোড় নিতে থাকে। শুরু হয়ে যায়, গোটা প্রক্রিয়াটিকে ধামাচাপা দেওয়ার তোড়জোড়। হঠাৎই সবকিছু চুপচাপ হয়ে যায়। আচমকা দেখা গেল এই নিয়ে একটি সিট গঠন করতে। পুলিশের হাত থেকে তদন্ত চলে গেল চার সদস্যের সিট-এর হাতে। এরপর রহস্য আরও বাড়ে। সিটের রহস্য নীরবতা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হতেই, চাপে পড়ে সিট ইউকো ব্যাঙ্কের মহিলা ক্যাশিয়ার শ্রীময়ীকে গ্রেপ্তার করে। এরপর তিনদিন পুলিশ রিমান্ডে রেখে শ্রীময়ীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। খবরে প্রকাশ, পুলিশ রিমান্ডে শ্রীময়ী অনেক তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে। প্রকৃত পক্ষে আরও কারা কারা এই ভয়ঙ্কর জালিয়াতি এবং আর্থিক অপরাধের সাথে যুক্ত তাদের সকলের নাম ধামই শ্রীময়ী পুলিশকে বলে দিয়েছে। এরপরই পুরো ঘটনা এবং তদন্ত ধামাচাপা দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় বলে অভিযোগ। এখানেই শেষ নয়, সিটের হাত থেকেও মামলা চলে যায়। এখন তদন্তভার ক্রাইম ব্রাঞ্চের হাতে। বিস্ময়ের ঘটনা হলো, ক্রাইম ব্রাঞ্চেরও এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনও হেলদোল লক্ষ্য করা যায়নি।
এদিকে, মঙ্গলবার রাজ্য বিধানসভায় পুর নিগমের ১৬ কোটি ৩৮ লক্ষ টাকার উপরে হাতিয়ে নিয়ে ঘটনার উপর যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা নিয়েও নানা মহল থেকে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর বিবৃতিতেও অনেক প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়নি। মুখ্যমন্ত্রীর জবাব ছিল অনেকটা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের। পুর নিগমকে একপ্রকার ক্লিনচিট দিয়ে দিলেন। যেমনটা, তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই পুর নিগমের মেয়র বলে দিয়েছিলেন, এই ঘটনায় নিগমের কেউ যুক্ত নয়। প্রশ্ন হচ্ছে মেয়র আগেই কি করে জানলেন? নিগমের সংশ্লিষ্ট আধিকারিকের হেপাজতে থাকা চেক (ছয়টি) কিভাবে ক্লোন হলো? প্রতারকচক্রকে সেই চেক ক্লোন করতে কে বা কারা দিল? কোথায় সেই ব্যক্তি, যিনি নিগমের অফিসার সেজে ব্যাঙ্কে গিয়ে বার বার জালি চেক জমা দিয়েছে? ওই ব্যক্তি কি পাতালে না আকাশে ভেনিস হয়ে গেছে? ব্যাঙ্কের আর কারা যুক্ত? এই সব প্রশ্নের কোনও জবাব আজও পাওয়া যায়নি। পাওয়া যাবে কিনা, এনিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তবে জনগণ ঠিকই নজর রাখবে। প্রশ্নগুলির জবাব চাইবে।