December 11, 2025

গঙ্গার নিম্নপ্রবাহ!!

 গঙ্গার নিম্নপ্রবাহ!!

বিহার বিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছেন, গঙ্গা বিহার থেকে বাংলার দিকে বয়ে গেছে। অর্থাৎ বিহারের পর এইবার বাঙলা বিজয়ের প্রত্যাশা নিয়ে এগিয়ে যাবেন মোদি। ২০২৬ সালে পশ্চিম বাংলায় নির্বাচনের প্রস্তুতিতে এই সময়ে ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধনী (এসআইআর) চলছে। যদিও পাশাপাশি রাজ্য হলেও বাঙলা ও বিহারের মাটির চরিত্র এক রকম নয়। ভোটের বাজারে বিহারে জাতপাতের বিবেচনা যতটা তীব্র, পশ্চিমবঙ্গে তা ধর্মীয় পরিচয়ে। প্রায় এক মাস হয়ে গেল বিহারের নির্বাচনের ফল নিয়ে বিস্ময় কাটছেই না। ২৪৩ আসনের বিধানসভায় বিজেপি জোটের দখলে গেল দুইশোর বেশি আসন।
দেখা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুব অল্প অল্প ভোটে বিরোধীরা হেরেছে, কিন্তু আসনের বড় ব্যবধানে বিজেপি, আরএসএস দারুন উজ্জীবিত। অপরদিকে ভোট বিশ্লেষকরা বলছেন সবই এসআইআরের ক্যারিশ্মা। দেশের বিরোধীরা বলছেন, এসআইআর কোনও মতেই ভোটার তালিকার সংশোধনী নয় এ হলো বিজেপির পছন্দের ভোটার তালিকা প্রণয়ন। ফলে বেশ প্রশ্নবিদ্ধ দাবি, বিহারের নির্বাচনি কলাকৌশল পশ্চিমবঙ্গও মাত করবে। তবে মমতার জন্য মাঠ পর্যায়ে উদ্বেগজনক অনেক কিছু আছে। প্রায় দেড় দশক তিনিও তার দল ক্ষমতায়। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বহু অভিযোগ জমেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। সর্বভারতীয় বিজেপির বিপরীতে তৃণমূল আঞ্চলিক দল। ভোটের আগে পুরো বিজেপি ইতিমধ্যে প্রায় সব জনপদের উপযোগী দুর্দান্ত এক নির্বাচনি মেশিনে পরিণত হয়েছে।
বিজেপির এসআইআর মূলত বিজেপি বিরোধীদের জামিন যেখানে শক্ত সে সব রাজ্যে শুরু হয়েছে। বিজেপির দাবি, বিহার পশ্চিমবঙ্গের মতো কিছু রাজ্যে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা বড় সংখ্যায় ভোটার তালিকায় নাম তুলে ফেলেছে। নিবিড় সংশোধন হলে বাদ পড়বে সে সব অবৈধ বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গারা। বিহারের অভিজ্ঞতা হল, এসআইআরে বাদ পড়ছে প্রধানত প্রান্তিক মানুষ, যারা পারিবারিক সব ধরনের নথিপত্রে ঠিকঠাক রাখার মতো দক্ষ নয়। বাদের হিসাবে মুসলমান বাদ পড়েছে ১০০ এর কম আর রোহিঙ্গা মিলেছিল ১০ এর কম। পশ্চিমবাংলায় এ রকম বাদের ঘটনা ঘটবে মুসলমান, মতুয়া ও আদিবাসী অঞ্চলগুলোতে। বাংলায় মুসলমানেরা তৃণমূল, কংগ্রেস ও বামেদের সমর্থক।
বিহারে বিধানসভা ভোটের আগেগ ভোটার তালিকায় এ রকম নিবিড় সংশোধন চালানো হয় যে সব কেন্দ্রে টায়েটায়ে জয় পরজায় নিশ্চিত হতো এমন আসনগুলোতে। এসআইআরে বিহারে প্রায় ৪৭ লাখ মানুষের নাম বাদ পড়ে।ফলাফলে বিজেপি বিরোধীদের ভোট কমার পেছনে এই বাদ পড়াদের অঙ্কটি ছিল বলে অনুমান করা হচ্ছে, যাদের বড় অংশই বিভিন্ন সময় বিহারে এসে থিতু হওয়া শ্রমজীবী মানুষ। পশ্চিম বাংলায় আগের দুটি বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল যথাক্রমে ২১১ ও ২১৫ আসন পেয়েছে। ভোটের হার ৪৫ শতাংশ। বিগত দুটি লোকসভা নির্বাচনেও পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের গড় ভোটও একই রকম। বিজেপির সঙ্গে ব্যবধান যথাক্রমে ২২ ও ২৯। কোনো কারণে তৃণমূলের ৩-৪ শতাংশ ভোট কমলে বা বিজেপির ভোট বাড়লে আসনের অঙ্ক অনেকখানি বদলে যাবে।এসআইআর এবং সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশে ‘তৌহিদী জনতা’র মাজার ভাঙাভাঙি আর বাউল পেটানোর ধারাবাহিক ঘটনাবলি বিজেপির পরিশ্রম কমিয়ে দিচ্ছে।
বিজেপির বরাবরের দাবি, বাংলায় গত ২৩ বছরে হিন্দু ভোট যেখানে ৭২ শতাংশ বেড়েছে, মুসলমান ভোটার সেখানে ১২৮ শতাংশ বেড়েছে। এ রকম প্রচারে এক ধরনের লাভ পাচ্ছে তারা। ২০১৬ সালে বিধানসভায় বিজেপি ৩ টি আসন পেয়েছিল, পাঁচ বছর পর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৭ আসন। সেই প্রচার এখনো আছে। মুসলমানপন্থী মমতা’র বিরুদ্ধে হিন্দু ভোট এক বাক্সে আনা বড় লক্ষ্য বিজেপির। পাশাপাশি এসআইআরে যদি অতীতে দেশান্তরিত মানুষদের মুসলমান অংশকে ভোটার তালিকা থেকে মুছে দেওয়া যায়, তাহলে বিজেপির আরেক ধাপ এগোতে সমস্যা নেই। এসআইআর ছাড়াও বিজেপি ইস্যু করার চেষ্টা করছে তৃণমূলের রাজত্বের দুর্নীতি ও মাস্তানিকেও। প্রায় দেড় দশকের শাসনে মমতার দলে সুবিধাভোগী যে গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, তার একাংশ সাধারণ সমাজে বিরক্তি তৈরির মতো যা যা ঘটিয়েছে বিজেপি সেগুলো প্রচারে আনতে চায়। কিন্তু বাংলা শব্দটির সঙ্গে মমতা নামের যে ইমেজ তৈরি করেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি তা বিজেপির জন্য নিঃসন্দেহে উদবেগের। ভোটযুদ্ধে মমতার সবল জায়গা নারী ও মুসলমন ভোটব্যাঙ্ক। এই দুই জায়গায় তৃণমূলের শিকড় উপড়ে ফেলা কঠিন। শুভেন্দু আধিকারির মতো নেতারা মুসলমানদের মধ্যে যে ভীতি ছড়িয়েছেন, তাতে অন্য কোনো প্রতীকে ভোট দেওয়ার নিরীক্ষা মুসলমানদের পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ। এরকম ভোটসংখ্যা এক কোটির বেশি, প্রায় ২৭ শতাংশ। ২৯৪ টি আসনের মধ্যে অন্তত ৫০ আসনে মুসলমন ভোেট জয়-পরাজয়ে নির্ধারক ভূমিকা রাখার মতো। কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, রূপশ্রী নামে নগদ সুবিধাগুলো নারীদের মধ্যে মমতার ইতিবাচক ইমেজ গড়ে রেখেছে। আবার কংগ্রেস ও বামপন্থীরা তাদের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির যে চেষ্টা করছে, তাতেও মমতার চেয়ে বিজেপি ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। তৃতীয় পক্ষের ভোট সংখ্যাগুরুর ভোট ব্যাঙ্ক থেকে যাবে।এর সঙ্গে বাড়তি মাত্রা মতুয়া সামাজ। এসআরআই, এই সমাজে ব্যাপক উদ্বেগ ছড়াচ্ছে, সেটাও তৃণমূলের পক্ষে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। নির্বাচনি নির্ঘন্ট এখন অনেক দেরি। সবাই এখন এই দিকটার প্রতি বেশি নজর রাখছে। ভোটার তালিকা হালনাগাদে যেসব দলিলপত্র চাওয়া হচ্ছে, অনেক মতুয়া ভোটার যেসব দিতে সমর্থন নন। অথচ বিগত দুই তিনটি ভোটে এই সমাজের ভোেট গেছে বিজেপির বাক্সে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *