ক্ষমতাধরদের শান্তিযাত্রা!!

গত বছর নির্বাচনি প্রচারে ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন,হোয়াইট হাউসের দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনেই রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে চলমান সংঘাতের তিনি সমাধান করবেন।কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়ার সাত মাসের মাথায় ট্রাম্প সেই প্রতিশ্রুতি পালনের কাছাকাছি পৌঁছুতে পেরেছেন কিনা সেই দিকেই এখন গোটা বিশ্বের নজর। ইতিমধ্যেই গত শুক্রবার আলাস্কায় হাইপ্রোফাইল বৈঠক করলেন ভ্লাদিমির পুতিন এবং ট্রাম্প। সেই বৈঠকের চারদিনের মাথায় সোমবার হোয়াইট হাউসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। সোমবারে রাতের সর্বশেষ হাইপ্রোফাইল বৈঠকের পরই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জোর গুঞ্জন শুরু হয়েছে- এবার হয়তো থামতে চলেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। জোর রাজনৈতিক চর্চার কারণটা হলো, সোমবারের জেলেনস্কি-ট্রাম্পের হাইপ্রোফাইল বৈঠকে শুধু জেলেনস্কি একাই আসেননি হোয়াইট হাউসে। সঙ্গে ছিলেন একাধিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রপ্রধানও। ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ডাকা বৈঠকে জেলেনস্কি ছাড়াও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো, ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলেনি, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার সহ আরও বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এই আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভাবেই এই বৈঠক থেকেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফোনে পুতিনের সঙ্গে কথা বলেন, প্রায় আধ ঘন্টা। সোমবারের হোয়াইট হাউসের হাইপ্রোফাইল বৈঠকটি যথেষ্ট ইতিবাচক ও সফল হয়েছে দাবি করে ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়েছেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের শান্তি ফেরাতে এবার দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান পুতিন ও জেলেনস্কিকে এক টেবিলে বসাবেন তিনি। প্রথমে পুতিন- জেলেনস্কির বৈঠকের পর দুই রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়ে বৈঠকে বসবেন ট্রাম্প নিজেই। ট্রাম্পের দাবি অনুযায়ী যদি সেটা সম্ভব হয়, তবে চার বছর ধরে চলতে থাকা একটি যুদ্ধের অবসানে ট্রাম্পের এই উদ্যোগ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয়। মনে রাখতে হবে, গত ফেব্রুয়ারীতে ট্রাম্প ও জেলেনস্কির বৈঠকটি যথেষ্ট তিক্ততার পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল। কার্যত সেই বৈঠকে জেলেনস্কিকে এক প্রকার ঘাড় ধাক্কা দিয়েই হোয়াইট হাউস থেকে বের করে দেওয়া হয়।কিন্তু এবারের বৈঠকের পরিবেশ দেখা গেছে বিভিন্ন।ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের কাঁধে ভরসার হাত রাখতেও দেখা গেছে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে।সেই দিকে থেকে ট্রাম্পের শান্তি উদ্যোগের এই প্রয়াস প্রায় তিন বছর পর বৈঠকে মিলিত হবেন পুতিন- জেলেনস্কি।
একটা কথা বলে রাখা খুব জরুরি যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এমন ঘটনা খুব কম ঘটেছে, যখন শীর্ষ ক্ষমতাধর দেশগুলোর নেতাদের বৈঠকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান এনে দিতে পেরেছে। ইতিহাসে অনেক শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে, যেগুলো যুদ্ধ ঠেকানোর পরিবর্তে পরিস্থিতিকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে গেছে। আর ‘যুদ্ধ বিরতি’ এবং ‘শান্তি চুক্তি’ এই দুইয়ের মধ্যেও যথেষ্ট ব্যবধান রয়েছে। ‘যুদ্ধ বিরতি’ কখনোই শান্তি আনতে পারেনি। বরং কিছুদিন বিশ্রামের পর নতুন উদ্যম নিয়ে আরও ভয়ংঙ্কর যুদ্ধ শুরু হতে দেখা গেছে। তেমনি চিরস্থায়ী শান্তিও যে স্থায়ী শান্তির পথ দেখাতে পারেনি তার ভুরি ভুরি প্রমাণ ইতিহাসে রয়েছে। তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, সোমবার জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকে ট্রাম্প ইউক্রেন প্রেসিডেন্টকে বলেছেন, চলতি বছরে আমি যে ছয়টি চুক্তি করেছি, সব কয়টি যুদ্ধ চলমান অবস্থাতেই হয়েছিল। আমি কোন যুদ্ধবিরতি করিনি। আমার মনে হয় আপনার কোন যুদ্ধবিরতির দরকার নেই। আসলে ট্রাম্প যে ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি চাইছেন না, সে ঘোষণা এসেছে আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের বৈঠরে পর পরই। সেখানে পুতিন দাবি করেছেন, যুদ্ধবিরতির আলোচনার আগে ইউক্রেনকে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করতে হবে। ট্রাম্পের এই ভূমিকা ও বক্তব্য থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, ট্রাম্প রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসছেন এবং সংঘাত থামাতে তিনি এখন পুতিন সমর্থিত পরিকল্পনার হাত ধরেই এগোতে চাইছেন। কারণ ট্রাম্প মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছেন এই যুদ্ধ থামানোর কাজটি তাঁর ধারণার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন। যদিও সোমবারের বৈঠকে বেশি গুরুত্ব পায় যুদ্ধবিরতি বা স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধের বিষয়টি। কিন্তু ট্রাম্প বললেন, যুদ্ধ বন্ধের আলোচনার আগে যুদ্ধবিরতি জরুরি নয়। অথচ শান্তি আলোচনার আগে শর্ত হিসাবে যুদ্ধবিরতি বারবার দাবি করে আসছিলেন জেলেনস্কি। এখানেই ট্রাম্প একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট সিমানুয়েল মাক্রোঁকে। বলেছেন, ‘আমার মনে হয় পুতিন একটা চুক্তি করতে চায়, বিষয়টি অদ্ভুত শোনালেও সে আমার জন্য হলেও একটা চুক্তি করবেই’। ট্রাম্পের এই বক্তব্য যদি সত্যি হয় সেক্ষেত্রে জেলেনস্কিকে যুদ্ধ বন্ধে জন্য রাশিয়ার দাবি মেনে রাজি করানোর জন্য চাপ বাড়াচ্ছেন ট্রাম্প ও ইউরোপীয় দেশগুলো সেটা অস্বীকারের সুযোগ নেই।কিন্তু এই শান্তির যাত্রার উদ্যোগ কতটা স্থায়িত্ব আনতে পারবে বা আদৌ সেই শান্তির যাত্রা সম্ভব কিনা সেদিকেই এখন বিশ্বের নজর।