December 11, 2025

কালিখাসা উৎপাদনে আজ নতুন পথ দেখাচ্ছে একদা সন্ত্রাসদীর্ণ বনকুল!!

 কালিখাসা উৎপাদনে আজ নতুন পথ দেখাচ্ছে একদা সন্ত্রাসদীর্ণ বনকুল!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-দক্ষিণ জেলার সাব্রুম মহকুমার বনকুল। একসময় যার নাম উচ্চারিত হতো আতঙ্কের সমার্থক হিসাবে। বৈরীদের দাপটে অস্থির হয়ে উঠেছিল গোটা জনজীবন। দুপুরের পরই শুনশান হয়ে যেতো গ্রামগুলো। রাস্তাঘাট থাকতো জনমানবহীন। একপ্রকার গৃহবন্দি অবস্থা জাতি-উপজাতির সাধারণ মানুষের। ১৯৮০-র রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা ও নব্বইয়ের দশকের অপহরণ, খুনের অন্ধকার সময় বনকুলের অর্থনীতিকে থামিয়ে দিয়েছিল দীর্ঘদিনের জন্য।
বাঘমারা, চালিতা বনকুল, বিজয়পুর, রূপাইছড়ি, ঘোড়াকাপ্পা, আইলমারা, তৈইছামা, তৈইকুম্ভা – উপজাতি অধ্যুষিত এই জনপদগুলোর প্রায় প্রতিটি মানুষ নিজের অভিজ্ঞতায় জানে এই ঘোর দু:সময়ের কথা। কৃষকদের উৎপাদিত ফসল বাজারে পৌঁছতে পারতো না, তার আগেই বৈরীদের ঘরে ‘ট্যাক্স’ পৌঁছে দিতে হতো। অন্যথায় আসত অমানুষিক অত্যাচার।
কিন্তু সময় বদলেছে। একবিংশ শতাব্দীর বনকুল আর সেই অন্ধকার অধ্যায়ের পাঠ বহন করে না। আজ ভোর থেকে গভীর রাত – যেকোনো সময়ে নিরাপদে চলাচল করা যায় বনকুলের যেকোনো প্রান্তে। চারদিকে এখন শুধু সোনালি ফসলের ঢেউ। আধুনিক সেচ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, পরিস্তুত পানীয় জল, যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য – সবই পৌঁছে গেছে মানুষের হাতের কাছে।
এই পরিবর্তনের দীর্ঘ ইতিহাসে রয়েছে বহু মানুষের অবদান। সাব্রুম মহকুমার বনকুল বিধানসভা দীর্ঘ দশক নেতৃত্ব পেয়েছিল স্বর্গীয় অংজু মগ চৌধুরীর মতো জননেতার হাতে। তার হাত ধরেই উপজাতি-জাতি মিলিত সমাজ গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে জিতেন চৌধুরী বিধায়ক হয়ে এবং পরবর্তীতে মন্ত্রী হিসেবে বনকুলের কৃষিব্যবস্থায় জলসেচের বিপ্লব ঘটান। যদিও নানা কারণে সেই সেচ প্রকল্প পরে মুখ থুবড়ে পড়ে। আজও চালিতা বনকুল ও বাঘমারার পুরনো সেচ প্রকল্প ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কোটি কোটি টাকার প্রকল্পের আজ গঙ্গাপ্রাপ্তি।
আজকের বনকুলে কৃষির পরিচিত মুখ ফুচিং চৌধুরী – নিপাট ভদ্রলোক, কৃষিই যার সাধনা। তার পূর্বপুরুষের দেখানো পথেই হাঁটছেন তিনি। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল কৃষির প্রতি মাটির টান আজও সমান অটুট। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ব্রিটিশ আমল থেকেই তাদের বাপ-ঠাকুরদার হাত ধরে এই এলাকায় কৃষির ভিত রচিত হয়েছিল। তাদের নামেই আজও পরিচিত অঙ্গজয় চৌধুরী পাড়া ও রূপাইছড়ি চৌধুরী পাড়া – যে গ্রামে কোনো এককালে বন্য শূকর-ভালুকের ভয়ে মানুষ পা রাখত না, আজ সেই এলাকা কৃষিতে স্বনামধন্য।
এই বছর ছয় কানি জমিতে ফুচিং চৌধুরী কালিখাসা (গোবিন্দভোগ) ধানের চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। খেতের ধারে দাঁড়াতেই নাকে আসে মিষ্টি সুবাস, কালো ধানের শিসগুলো দেখে মনে হয় প্রকৃতি যেন নিজেই হাসিমুখে আশীর্বাদ করেছে এই কৃষককে।এতেই শেষ নয়। তার বিশাল জমিতে রয়েছে নানা প্রজাতির ধান।
তিনি জানান, তাদের সম্পত্তি প্রায় আশি কানি – যা জুড়ে রয়েছে রাবার, সুপারি, নারকেল, আখ, সুগন্ধি লেবু, ননি গাছ সহ অসংখ্য কৃষিজ ফসল। বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই হলেও আজও তিনি কর্মঠ। এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে দিল্লীর একটি বেসরকারী সংস্থায় ইঞ্জিনীয়ার, মেয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে আগরতলায়। এলাকায় শিক্ষিত পরিবার হিসেবে সম্মান অর্জন করেছেন তারা।ফুচিং চৌধুরী শুধু কৃষক নন, একজন পরিশ্রমী পশুপালকও। হাঁস-মুরগি থেকে গরু – সবই রয়েছে বাড়িতে। একসময় তার গরুর ফার্মে দিনে চল্লিশ-ষাট লিটার দুধ উৎপাদিত হতো। সময় ও লোকবলের অভাবে তা কমে এসেছে। পাশাপাশি বড় পুকুরে মাছ চাষ, তার চারদিকে সুপারি-নারকেল-কলার বাগান – সব মিলিয়ে এক আদর্শ কৃষক তার সমগ্র পরিসরে। দুই হাজার রাবার গাছ, তিনশ সুপারি, পঞ্চাশটি নারকেল গাছ, আখের খেত। কী নেই। প্রকৃতি যেন দুই হাতে উক্ত কৃষক পরিবারকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
সরকারী সহযোগিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাম আমলে একসময় আম বাগানের চারা পেয়েছিলেন। পরে দীর্ঘ সময় কিছু পাননি। বর্তমানে কৃষিভাতা ও বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন।
এই বছর রাজ্য কৃষি দপ্তর ও স্থানীয় বিধায়ক মাইলাফু মগের সহায়তায় প্রায় ছয় কানি জমিতে গোবিন্দভোেগ ধানের বিশেষ চাষ করা হয়েছে।রূপাইছড়ি কৃষি মহকুমার আধিকারিক ডিকেন ত্রিপুরা জানান, আগামী মরশুমে কালিখাসা ধান চাষে বনকুলকে নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিতে তিনি বদ্ধপরিকর, আর এই অভিযানের রোল মডেল ফুচিং চৌধুরী।
কৃষিকে আপন করে নিয়ে ফুচিং চৌধুরীর জীবন আজ অনুকরণের দৃষ্টান্ত। এক ছেলে-মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করার পাশাপাশি প্রকৃতির সান্নিধ্যে প্রতিদিনের শ্রমেই তিনি পান জীবনের আনন্দ।একদা বৈরীদের আতঙ্কে থমকে থাকা বনকুল আজ কৃষির আলোয় আলোকিত। এই আলোকিত পথচলার সবচেয়ে উজ্জ্বল মুখগুলোর একটি নি:সন্দেহে ফুচিং চৌধুরী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *