দেশি-বিদেশিদের উপচে পড়া ভিড়,আন্তর্জাতিক পর্যটন মানচিত্রে জম্পুই!!
ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ!!
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দুইদিনের সফরে আজ ভারতে এসেছেন।তার এই ভারত সফর নিছক একটি কূটনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা নয় – এটি বর্তমান বৈশ্বিক ক্ষমতার পালাবদলের বুকে ভারতের অবস্থান পুনর্নির্ধারণের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক উত্তেজনা, অন্যদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহ্যগত মিত্রতা- এই দুই মেরুর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতেই নয়, ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতেও মোদি সরকার এই সফরকে অভূতপূর্ব গুরুত্ব দিচ্ছে।
কারণ বাস্তবতা খুব সরল।যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার – প্রায় আশি বিলিয়ন ডলার। তার বিপরীতে রাশিয়ায় রপ্তানি মাত্র ৪.৮৮ বিলিয়ন ডলার। এই অমিলের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভারতের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কাঠামোর প্রকৃত দুর্বলতা। মার্কিন বাজার হারানো সম্ভব নয়- এটা কেবল অর্থনীতির ভাষায় নয়, ক্ষমতার রাজনীতির ভাষায়ও স্পষ্ট। সুতরাং মার্কিন ট্রাম্প প্রশাসনের চাপের মুখে রাশিয়ার তেল কেনা কমানো ছাড়া ভারতের হাতে উপায়ও ছিল না।
কিন্তু ভারতের কৌশলগত মানচিত্রে রাশিয়াকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। বরং পুতিনের এই সফর দেখিয়ে দিচ্ছে – ভারত নিজের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিকে একমুখী নির্ভরশীলতার উপর দাঁড় করাতে রাজি নয়। আর এ কারণেই দুই দেশ বাণিজ্যকে বৈচিত্র্যময় করার চেষ্টা করছে। আজকের ৬৮.৭২ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২০৩০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্য কেবল একটি অর্থনৈতিক সংখ্যাই নয় – এটি ভূরাজনৈতিক সংকেত।
রাশিয়ার দিক থেকেই বাণিজ্য সবচেয়ে বেশি হেলে থাকা ৬৩.৮৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি – ভারতের চিরন্তন দোদুল্যমান বাণিজ্য কাঠামোকে আরও স্পষ্ট করে। অস্ত্র কেনা, তেল খনিজ – এই সীমিত নির্ভরশীলতা ভারত চাইছে ভাঙতে। কৃষি যন্ত্রপাতি, ফার্মা, পরিষেবা খাতে রপ্তানি বাড়ানোর যে কৌশল ভারত নিচ্ছে, তা মূলত রাশিয়ার বাজারে নিজেদের নতুনভাবে প্রতিষ্ঠার প্রকল্প। এবং রাশিয়াও তা চাইছে- কারণ পশ্চিম নিষেধাজ্ঞায় কোণঠাসা মস্কোর জন্য ভারতীয় বাজার, ভারতীয় শ্রমশক্তি এবং ভারতীয় প্রযুক্তি সহযোগিতা এখন কৌশলগত সম্পদ।আর তাই এই সফরে শ্রমিক সরবরাহ চুক্তির আলোচনা মোটেই সামান্য বিষয় নয়। এটি মূলত যুক্তরাষ্ট্র-কেন্দ্রিক অভিবাসী শ্রমবাজার থেকে ভারতকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নিয়ে বহুমাত্রিক বাজার নির্মাণের পদক্ষেপ। যত বেশি ভারতীয় শ্রমিক, প্রযুক্তিবিদ, বিশেষজ্ঞ রাশিয়ায় কাজ করবে, তত দ্রুত দুই দেশের সম্পর্ক অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্তরে নতুন বাস্তবতা তৈরি করবে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতার চাপ কমানোর আরেকটি উপায়।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- ডিডলারাইজেশন।ডলারকে পাশ
কাটিয়ে রুপি, দিরহাম, ইউয়ান দিয়ে লেনদেনের যে পথ রাশিয়া-ভারত তৈরি করছে, তা কেবল বাণিজ্যের বিকল্প পথ নয়, এটি ভবিষ্যতের ভূরাজনীতির নতুন সমীকরণ। রাশিয়ার এসপিএফএস পেমেন্ট সিস্টেমকে ভারতের আরইউপি বা অন্যান্য নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করার আলোচনা মূলত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও অর্থনৈতিক চাপকে নিষ্ক্রিয় করার কৌশল।
তবে প্রতিরক্ষা খাত এখনও এই সম্পর্কের অদৃশ্য কেন্দ্রবিন্দু। এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, পরবর্তী প্রজন্মের এসইউ-৫৭যুদ্ধবিমান- এই সব আলোচনাই দেখাচ্ছে যে নয়াদিল্লী এখনো রাশিয়ার উপর নির্দিষ্ট কৌশলগত নির্ভরশীলতা ছাড়তে প্রস্তুত নয়। ‘অপারেশন সিন্দুরে’ রাশিয়ার অস্ত্রের কার্যকারিতা ভারতকে আরও আশ্বস্ত করেছে, তাই নতুন এস-৪০০ কেনার সিদ্ধান্তও সময়ের অপেক্ষা।
সামগ্রিকভাবে পুতিনের এই সফর ভারতের সামনে বহুস্তরীয় এক বাস্তবতা তুলে ধরেছে। একদিকে রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক বিশ্বাস, অন্যদিকে মার্কিন বাজারের অর্থনৈতিক অপরিহার্যতা। এই প্রেক্ষাপটে এটা বলা ভুল হবে না যে, বিশ্ব দ্রুত গোলার্ধভাগে বিভক্ত হচ্ছে, সেখানে ভারত নিজের জায়গা নিশ্চিত করতে চাইছে বহুমুখী কৌশল দিয়ে – বাণিজ্যের বিকল্প পথ, পেমেন্ট ব্যবস্থার স্বাধিকার, প্রতিরক্ষা সহযোগিতার অব্যাহততা এবং শ্রমশক্তির বৈচিত্র্যই যার ভিত্তি।
পুতিনের এই সফর এবং মোদির সাথে আসন্ন বৈঠক এই বার্তাই দিতে চলেছে – ভারত এখন সেই অবস্থানে দাঁড়িয়ে, যেখানে তাকে আর কেউ নিজের পররাষ্ট্রনীতির পরিশিষ্ট বানাতে পারবে না। ভারত তার স্বার্থেই বিশ্বশক্তিগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ভারসাম্যহীন নয়, বরং ভারসাম্যময় করতে চাইছে এবং সেই কৌশলগত স্বাধীনতার নকশায় রাশিয়া এখনও একটি অপরিহার্য স্তম্ভ।