August 1, 2025

ঐতিহাসিক জুলাই: বিধানসভার পদচিহ্ন,গণতন্ত্রের পীঠস্থানের দীর্ঘ যাত্রার স্মৃতিচারণে একমঞ্চে শাসক-বিরোধী!!

 ঐতিহাসিক জুলাই: বিধানসভার পদচিহ্ন,গণতন্ত্রের পীঠস্থানের দীর্ঘ যাত্রার স্মৃতিচারণে একমঞ্চে শাসক-বিরোধী!!

অনলাইন প্রতিনিধি:-ত্রিপুরা বিধানসভা, রাজ্যের গণতান্ত্রিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ – যার ইতিহাস শুধুই একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের নয়, বরং একটি জনগণের রাষ্ট্র নির্মাণের। আর সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী ‘ঐতিহাসিক জুলাই’ অনুষ্ঠান এবার যেন এক অনন্য আবেগে ভেসে উঠল বিধানসভা চত্বরে আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে।

মঙ্গলবার রাজ্য বিধানসভায় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার মানিক সাহা, অধ্যক্ষ বিশ্ববন্ধু সেন, উপাধ্যক্ষ রাম প্রসাদ পাল, সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী রতনলাল নাথ, বিরোধী দলনেতা জিতেন্দ্র চৌধুরী এবং কংগ্রেস পরিষদীয় দলনেতা বীরজিৎ সিনহা সহ অন্যান্য মন্ত্রী এবং বিধানসভার সদস্যরা। এই মহতি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার মানিক সাহা বিধানসভার অতীত ও বর্তমান নিয়ে তার নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। বক্তব্য রাখতে গিয়ে অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে বিরোধী দলনেতা প্রত্যেকেই তাদের অভিজ্ঞতা এবং নানা স্মৃতিকথা তুলে ধরেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, গণতন্ত্রের এক পবিত্র পীঠস্থান হলো বিধানসভা। রাজ্যের জনগণের সুখ সমৃদ্ধি ও সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য বিধানসভায় আলোচনা করা হয় এবং রাজ্যবাসীর কল্যাণে বিভিন্ন আইন এই বিধানসভায় প্রণীত হয়। জনপ্রতিনিধিদের জন্য বিধানসভা একটি মন্দির ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিধানসভা মানেই সব কিছুর বিধান।মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন,১৯৬৩ সালের ১ জুলাই ত্রিপুরা বিধানসভা গঠিত হয়েছিল।২০১১ সালের ২২ জুলাই উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ থেকে ত্রিপুরা বিধানসভা বর্তমান নতুন বিধানসভা ভবনে স্থানান্তরিত হয়েছিল। রাজ্যে গণতন্ত্র প্রসারের ক্ষেত্রে জুলাই মাসের বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। তবে এ দিনের অনুষ্ঠানে সকলের আকর্ষণই ছিলেন রাজ্যের বরিষ্ঠ রাজনীতিবিদ, বর্তমান বিজেপি জোট সরকারের সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী রতনলাল নাথ। দীর্ঘ সময় বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। অনেকেই বলেন, বিরোধী দলনেতা হিসাবে তিনি প্রবাদপ্রতিম নৃপেন চক্রবর্তীকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। এমনকী পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব কত গভীরে, সেটাও দেখিয়েছিলেন রতনবাবু। এবার তিনি মন্ত্রীর ভূমিকায়। ফলে রাজ্য বিধানসভায় নানারূপে তার উত্থান এবং অভিজ্ঞতার কথা শোনার জন্য শাসক এবং বিরোধী এমন কী বিধানসভার কর্মীরা পর্যন্ত মুখিয়েছিলেন। রতনবাবু রাজ্য মন্ত্রিসভার প্রবীণতম সদস্য, সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী – একাধারে এই প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘদিনের সাথী। আবার অন্যদিকে একজন স্মৃতিকাতর কাণ্ডারি। যিনি এদিন অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন রচনা করলেন তার বক্তব্যে। তার বক্তব্য চলাকালীন শাসক এবং বিরোধী উভয় দলের সদস্যরাই স্মৃতিতে হারিয়ে যান। রতনবাবু বলেন, ত্রিপুরা বিধানসভা একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হলেও এটি কেবলমাত্র আইন প্রণয়নের স্থল নয়- এটি হল এক সভ্যতার ধারক ও বাহক। এখানে ভিন্ন মত, ভিন্ন চিন্তা ও মতভেদ থাকা সত্ত্বেও, সকল সদস্য মিলিতভাবে জনগণের কল্যাণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। রতনবাবু এদিন তুলে ধরেন ত্রিপুরা বিধানসভার দীর্ঘ ও গৌরবোজ্জ্বল যাত্রাপথ। স্বাধীন ভারতের অঙ্গভুক্ত হওয়ার পর ১৯৫৬ সালে ত্রিপুরায় গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং ১৯৬৩ সালের ১লা জুলাই ‘ত্রিপুরা টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল’ থেকে রূপান্তরিত হয়ে যাত্রা শুরু করে ত্রিপুরা বিধানসভা।এভাবেই শচীন্দ্রলাল সিংহের নেতৃত্বে গঠিত হয় রাজ্যের প্রথম মন্ত্রিসভা – যেটিকে রতনবাবু উল্লেখ
করেন, ত্রিপুরার সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনালিপি হিসাবে।
এরপর আসে ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারী।ঐতিহাসিক নর্থ ইস্টার্ন এরিয়াস জানুয়ারা।(রিঅর্গানাইজেশন) অ্যাক্ট – এর মাধ্যমে ত্রিপুরা পায় পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা।গঠিত হয় পূর্ণাঙ্গ রাজ্য সরকার।সুখময় সেনগুপ্ত হন প্রথম মুখ্যমন্ত্রী।সেই সময় থেকেই ত্রিপুরা বিধানসভা হয়ে ওঠে রাজ্যের আইন প্রণয়ন এবং গণতন্ত্রের চর্চার কেন্দ্রস্থল।
রতনবাবু বিশেষভাবে উল্লেখ করেন ২০১১ সালের ২২ জুলাইয়ের দিনটি -যেদিন উজ্জয়ন্ত রাজপ্রাসাদ থেকে স্থানান্তরিত হয়ে বর্তমান পরিকল্পিত ও আধুনিক ভবনে শুরু হয় বিধানসভার কার্যক্রম। এই ভবনটি কেবলমাত্র একটি স্থাপত্য নয়, এটি গণতন্ত্রের একটি প্রতীক, বলেন, রতনবাবু। এর প্রতিটি দেয়ালে, করিডর ও অধিবেশন কক্ষ আমার স্মৃতির অংশ, আমার দায়িত্ববোধের সাক্ষ্য।
১৯৯৩ সাল থেকে একটানা এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন রতন লাল নাথ
প্রথমে একজন বিধায়ক হিসাবে, তারপর বিরোধী দলনেতা হিসাবে এবং বর্তমানে মন্ত্রী হিসাবে। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ত্রিপুরার আইনসভা হয়ে উঠেছে তার রাজনৈতিক, নৈতিক ও মানবিক যাত্রার অন্যতম সাক্ষী।
একটি অত্যন্ত আবেগঘন মুহূর্তে রতনবাবু স্মরণ করলেন, কীভাবে তিনি বিরোধী দলনেতা থাকা অবস্থায় তৎকালীন অধ্যক্ষ অনাগ্রহী থাকার পরেও নিজ উদ্যোগে উজ্জয়ন্ত রাজপ্রাসাদে থাকা বিধানসভা ভবনে প্রতিষ্ঠা দিবস উদ্যাপন করেছিলেন। সেই সময় সম্মানিত বর্তমান ও প্রাক্তন বিধায়ক এবং কর্মীদের একত্র করে উদ্যাপন করেছিলেন এই গুরুত্বপূর্ণ দিনটি।
পরে, ২০১৩ সালে বিধানসভার ৫০ বর্ষ পূর্তিতে এক ‘গোল্ডেন জুবিলি স্পেশাল সেশনের’ আয়োজন হয় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর সহযোগিতায়। লোকসভার অধ্যক্ষা মীরা কুমার আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। যেখানে এক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা এবং প্রাক্তন বিধায়কদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানও হয়।
এই বছরের ‘ঐতিহাসিক জুলাই’ অনুষ্ঠানে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। রতনবাবু বলেন, একটি গাছ রোপণ মানে কেবল একটি বৃক্ষ নয়- এটি জীবনের, পরিবেশের ও ভবিষ্যতের প্রতি একটি অঙ্গীকার। তিনি বলেন, গণতন্ত্র যেমন ধৈর্য, পরিচার্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে বিকশিত হয়, তেমনই একটি গাছও সময় নিয়ে বড় হয় এবং আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করে। এই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির মাধ্যমে বিধানসভা সচিবালয় এক শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে যে, তারা শুধু আইন প্রণয়নেই নয়, পরিবেশ সুরক্ষাতেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রতনবাবু তার বক্তব্যে বলেন, গণতন্ত্র মানে শুধুমাত্র নির্বাচন নয়, এটি জনগণের আকাঙক্ষা, স্বপ্ন ও অধিকার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার। বিধধনসভার ৬০ জন সদস্য প্রতিনিয়ত এই প্রতিষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করে রাখছেন তাদের যুক্তিপূর্ণ, সুচিহ্নিত এবং দায়িত্বশীল অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
অনুষ্ঠানের শেষভাগে রতনবাবু ত্রিপুরা বিধানসভার অধ্যক্ষ, সচিব, কর্মচারী এবং উপস্থিত অতিথিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে বলেন, আমি আশা করব -‘ঐতিহাসিক জুলাই’ অনুষ্ঠানের এই ঐতিহ্য ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে এবং আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবে সেই বার্তা- কীভাবে একটি সভ্যতা, একটি গণতন্ত্র এবং একটি জনমুখী প্রশাসন গড়ে তোলা যায়।
ত্রিপুরা বিধানসভার অতীত ও বর্তমান নিয়ে রতনলাল নাথের এই বক্তব্য যেন কেবল একটি অনুষ্ঠানিক বিবৃতিই নয়, বরং একটি চলমান ইতিহাসের সংরক্ষণ। একদিকে প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা হিসাবে তার সংগ্রামী স্মৃতি, অন্যদিকে, মন্ত্রী হিসাবে ভবিষ্যতের জন্য তার প্রত্যাশা- এই দুয়ের মধ্য দিয়ে যেন ফুটে উঠল এক ধ্রুপদী রাজনৈতিক দর্শন। যা গণতন্ত্রকে শুধু শাসন নয়, বরং এক জীবন্ত সংস্কৃতি হিসাবে চিহ্নিত করে।
‘ঐতিহাসিক জুলাইঃ পদচিহ্ন’ শুধু একটি অনুষ্ঠান নয় এটি ত্রিপুরার গণতান্ত্রিক ইতিাহেসর এক প্রতীকি আলেখ্য।সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী রতনলাল নাথের মতো একজন অভিজ্ঞ নেতার মুখে যখন শোনা যায় বিধানসভার ইতিহাস, স্মৃতি ও ভবিষ্যতের প্রত্যাশা, তখন তা হয়ে উঠে এক মূল্যবান দলিল। ত্রিপুরা বিধানসভা শুধু একটি রাজনৈতিক কেন্দ্র নয়- ইটি ইতিহাস, ঐতিহ্য, ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি এবং গণতন্ত্রের চর্চার এক পরম কেন্দ্র। এখানকার প্রতিটি সদস্যের চোখ দিয়ে দেখা এই প্রতিষ্ঠান, তার, স্মৃতির মানচিত্র, তার লালিত গণতান্ত্রিক চেতনা প্রত্যেককে অনুপ্রাণিত করে ত্রিপুরার গণতন্ত্রকে আরও সমৃদ্ধ করতো। নানা দল থেকে উঠে আসা বিধায়ক মন্ত্রীরা এ দিন যেন ছিলেন একে অপরের এক পরম আত্মীয়রূপে। বিধানসভা হয়ে উঠেছিল মহামিলনের সঙ্গমস্থল। এই মহতি অনুষ্ঠানে এ দিন অধ্যক্ষ বিশ্ববন্ধু সেন, বিরোধী দলনেতা জিতেন্দ্র চৌধুরী, বনমন্ত্রী অনিমেষ দেববর্মা প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। স্বাগত ভাষণ রাখেন উপাধ্যক্ষ রামপ্রসাদ পাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *