এশিয়া মহাদেশের যুদ্ধ!!

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের আবহ কাটতে না কাটতেই ফের যুদ্ধ শুরু হয়েছে এশিয়া মহাদেশে। থাইল্যাণ্ড কম্বোডিয়ার যুদ্ধে তিন দিনে অন্ততপক্ষে ত্রিশ জনের মৃত্যু এবং এক লক্ষ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে। যেখানে যুদ্ধ সেখানেই আমেরিকার উপস্থিতি থেকে যায়। এই ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। বিবদমান দুই দেশের মধ্যে থাইল্যান্ড আমেরিকার অস্ত্রে, শক্তিতে সজ্জিত। আকার আয়তনেও দেশটি কম্বোডিয়ার তুলনায় বড়, তাঁর জনসংখ্যা, উৎপাদন সবই কম্বোডিয়ার তুলনায় বেশি। অন্যদিকে যুদ্ধ যেরকম দুই দিকের দ্বন্দ্ব মূলক সম্পর্কের কারণে হয়ে থাকে, এখানেও তাঁর ব্যতিক্রম ঘটার সুযোগ নেই। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় যেভাবে চিন পেছন থেকে পাকিস্তানকে সহায়তা করে গেছে ঠিক সেইভাবেই কম্বোডিয়াকেও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে চিন। বিষয়টি একতরফা হচ্ছিল না। অগত্যা ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার দুই দেশের সঙ্গে কথা বললেন।
একই কায়দায় দুই দেশকে হুমকি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, যুদ্ধ বন্ধ করো, না হলে আমেরিকার সঙ্গে যে কোনোও রকম ব্যবসা বাণিজ্যের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। ট্রাম্প স্বভাবমতো জানিয়েছেন, দুই পক্ষই যুদ্ধ বন্ধে রাজি হয়েছে। অবশ্য শনিবার ট্রাম্পের এই ঘোষণার পর সীমান্তে রবিবারও দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এই সমর অঙ্গনে একপাশে রয়েছে আমেরিকার দীর্ঘদিনের মিত্র ও কয়েক দশকের যুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনী। আর অন্যপাশে চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দেশ কম্বোডিয়ার তুলনামূলকভাবে কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সামরিক শক্তি। এক শতাব্দী ও আগে ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স যখন তাদের সীমান্ত ভাগ করে দিয়েছিল, তখন থেকেই ব্যাঙ্কক ও নমপেন সীমান্তের একটি বিতর্কিত ভূখণ্ড নিয়ে লড়াই করে আসছে। বৃহস্পতিবার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ত্রিশের বেশি মানুষ নিহত, কয়েক ডজন আহত এবং দেড় লক্ষের বেশি নাগরিককে সরিয়ে নিতে হয়েছে। এই সংঘাতের পেছনে দুই পক্ষের যে সামরিক ইতিহাস রয়েছে এবং যুদ্ধ করার মানসিকতা তৈরির যে প্রেক্ষাপট তা একেবারে সংক্ষিপ্ত নয়।
থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনী প্রতিবেশী কম্বোডিয়ার চেয়ে জনবল ও অস্ত্রশস্ত্রে অনেক বড়। থাইল্যাণ্ডের মোট ৩ লাখ ৬১হাজার সক্রিয় সামরিক সদস্য রয়েছে, যা কম্বোডিয়ার তিন গুণ। আর এই সেনাদের হাতে এমন সব অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে যা কম্বোডিয়ার সেনাদের জন্য স্বপ্ন। ২০২৪ সালের একটি রিপোর্ট জানায়, এই অঞ্চলে ২৭ টি আঞ্চলিক দেশের সামরিক সক্ষমতার র্যাঙ্কিংয়ে থাইল্যাণ্ড ১৪ তম স্থানে রয়েছে, কম্বোডিয়া ২৩ তম স্থানে।এই বৈষম্য স্বাভাবিক, কারণ থাইল্যাণ্ডের জনসংখ্যা কম্বোডিয়ার চারগুণ এবং জিডিপি ১০ গুণেরও বেশি। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে আঞ্চলিক যুদ্ধ যেভাবে কম্বোডিয়া,লাওস এবং ভিয়েতনামকে গ্রাস করেছিল, থাইল্যান্ড সেখান থেকে মুক্ত ছিল। এমনকী ইউরোপীয় উপনিবেশবাদের ধ্বংসযজ্ঞ থেকেও রেহাই পেয়েছিল দেশটি। সামগ্রিকভাবে সামরিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষমতা সহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় থাইল্যান্ড ১০ম স্থানে রয়েছে, যেটি মধ্যম মানের শক্তি হিসেবে বিবেচিত, ইন্দোনেশিয়ার ঠিক পেছনে আবার মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোর চেয়ে এগিয়ে।র্যাঙ্কিংয়ে কম্বোডিয়াকে বিবেচনা করা হয় এশিয়ার একটি ক্ষুদ্র শক্তি হিসেবে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং লাওসের মতো দেশগুলোর সঙ্গে একই গ্রুপে অবস্থান কম্বোডিয়ার। থাইল্যাণ্ডের সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে দেশটির রাজনীতিতে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে। বহু বছর ধরে সামরিক বাহিনী, রাজতন্ত্র এবং অভিজাত ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত একটি রক্ষণশীল শক্তিশালী গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার করে আছে। ১৯৩২ থেকে জেনারেলরা ২০ টি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছে, প্রায়শই গণতান্ত্রিক সরকারগুলোকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে এবং সামরিক বাহিনী নিজেদের রাজতন্ত্রের একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। ১৯৫৪ সালে ম্যানিলা চুক্তি স্বাক্ষর দিয়ে আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব শুরু হয় থাইল্যাণ্ডের। তখন থেকে দুই দেশের মধ্যে মিত্রতার সম্পর্ক। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় থাইল্যাণ্ড তাদের বিমান ঘাঁটিতে বি- ৫২ বোমারু বিমানসহ মার্কিন বিমানবাহিনীর সরঞ্জামের জায়গা দিয়েছিল। থাইল্যাণ্ড ন্যাটোর বাইরে আমেরিকার প্রধানতম মিত্র, ফলে কয়েক দশক ধরে তাদের অস্ত্র কর্মসূচির জন্য মার্কিন সমর্থন পেয়ে আসছে।
কম্বোডিয়ার সামরিক বাহিনী থাইল্যাণ্ডের তুলনায় একেবারে নবীন। ১৯৯৩ সালে কমিউনিস্ট সরকারের বাহিনীর সঙ্গে দুটি অ-কমিউনিস্ট প্রতিরোধ বাহিনী একত্রিত হয়ে এই সেনাবাহিনী গঠিত হয়। আন্তর্জাতিক প্রতিরক্ষায় চিন ও ভিয়েতনামের সঙ্গে কম্বোডিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের জন্য রাশিয়ার ওপর ঐতিহ্যগতভাবে নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও, কম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের একটি প্রধান সরবরাহকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চিন। বেইজিং কম্বোডিয়ায় একটি নৌঘাঁটিও তৈরি করেছে। কম্বোডিয়া ও চিন মে মাসে গোল্ডেন ড্রাগন নামে তাদের বাৎসরিক যৌথ সামরিক মহড়া সপ্তমবারের মতো শেষ করেছে, যা এ যাবৎকালের বৃহত্তম মহড়া হিসেবে প্রচার -রা হয়েছিল এবং এতে গোলাবারুদ ছোড়ার প্রশিক্ষণও অন্তর্ভুক্ত ছিল।চিনের পিপলস লিবারেশন আর্মির ওয়েবসাইট অনুসারে, দুই দেশের মধ্যে এই তিরক্ষাসম্পর্কটি এ বছর ‘একটি নতুন স্তরে পৌঁছাবে এবং একটি নতুন উন্নয়ন
ঘটাবে বলে আশা ব্যক্ত করা হচ্ছে।
এই ধরনের সাজগোজ দিয়েই শুধু যুদ্ধ হয় না। যুদ্ধে আরও হাজারটা অনুষঙ্গ থেকে যায়। যদিও যুদ্ধ শুধু অপচয়ই ঘটায়। এর পরেও যুদ্ধ পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে হয়েই থাকে। ট্রাম্পে ধাক্কায় ইজরায়েল ইরান যুদ্ধ আপাতত থেকে গেলেও অদূর ভবিষ্যতেই এক দেশ আর এক দেশকে আক্রমণ করবে না, তাঁর কোনোও গ্যারান্টি নেই। যদিও এই বারের সংঘাতে দুটি দেশের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে। সেইদিক থেকে এশিয়া মহাদেশে দুটি ছোট এবং তস্য ছোট দেশের মধ্যেকার যুদ্ধ কোনোও ভয়াবহ রূপ নেওয়ার আগেই বন্ধ হয়ে যাওয়া ভাল। যদিও দুই প্রতিপক্ষের পেছনে বিশ্বের বড় দুই শক্তির উপস্থিতি স্পষ্ট। তাতে দুই পরোক্ষ দেশের লাভ বা ক্ষতি হতে পারে যুদ্ধের সর্বশেষ ফলাফলে। কিন্তু শুধু ক্ষতিই হবে থাইল্যাণ্ড আর কম্বোডিয়ার।