December 16, 2025

উপমহাদেশীয়

 উপমহাদেশীয়

পাকিস্তানের যে কোনও ঘটনা, সে ছোট হোক বা বড়-সবই ভারতীয়দের রুচির বিষয়।একই অবস্থা ওই দিকেও।এই চির কৌতূহলকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হয় কত গল্প উপন্যাস।ভারতীয় পরিচালকদের নির্মিত ছবিতে দেখানো হয়ে থাকে পাকিস্তানের প্রতিটি নাগরিক ভারতের ওপর হামলা চালাতে না নেয়েখেয়ে তৈরি হয়ে থাকে। ওই দিকেও নিশ্চয়ই এমনই হয়। কারণ এই হলেই তো ব্যবসা বা কাটতি হয়। যদিও এটি কোনভাবেই বাস্তব হতে পারে না। ক্ষুধার রঙ সর্বত্র এক। দারিদ্র আর অশিক্ষার প্রতিফলনও একই থাকে দেশে দেশে। 

আর ভারত পাকিস্তান তো সেই গ্রামীণ বাংলা প্রবাদকে চিরদিন মনে করায়-ভাইয়ের শত্রু ভাই আর মাছের শত্রু ঘাই।
একদার অখণ্ডিত দেশের ছোট অংশ পাকিস্তান আজ নিকট প্রতিবেশী রাষ্ট্র। পাকিস্তান অদ্ভুত থমথমে অবস্থার মধ্যে আছে। যেন একদফায় ঝড় থেমে যাওয়ার পর এবার আর এক দফার আশঙ্কার প্রহর গোনা। নতুন করে অস্থিরতার একটি পরিস্থিতি। সেই দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা ইমরান খান এখন আদিয়ালা জেলে বন্দি রয়েছেন। ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির পুরো ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে। শাহবাজ শরিফ নামমাত্র প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। দেশের প্রতিটি মানুষ জানেন, ক্ষমতার রাশ সেনাবাহিনীর হাতেই। মানে একটি ব্যর্থ গণতন্ত্রের জাহাজ সামনে এগোতে চেষ্টা করছে আর বরফের চাঙরে বাধা পেয়ে পেয়ে থেমে যাচ্ছে। নয়াদিল্লীর জন্য পাকিস্তানের এই অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা শিরঃপীড়ার কারণ। এই ঘটনাগুলি তো দূরের নয়। একেবারে গা ঘেঁষে হচ্ছে। যা দক্ষিণ এশিয়ার নড়বড়ে নিরাপত্তা ভারসাম্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে।
মাত্র কিছুদিন আগে পহেলগাঁও সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে ভারত। এর জেরে অপারেশন সিদুর নামে পাকিস্তানে সামরিক অভিযান হলো। এই সময়ে ভারতের আর কী কর্তব্য! দেশটিতে ইমরান খানের পতন পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নাটকীয় ঘটনা। দুর্নীতির মামলায় ইমরানের সাজা এবং তার দলকে ভেঙে দেওয়ার নানা উদ্যোগ-দেশটিকে একটি জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন করিয়েছে।এর পরেও অদ্ভুতরকম ভাবে ইমরান খানই এখনও পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক মুখ। জেলে আটক থাকায় তাঁর জনপ্রিয়তা কমেনি, বরং তিনি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। পাকিস্তানের নাগরিকেরা যারা ভারতের ছোটবড় ঘটনার প্রতি নজর রেখে থাকেন তারা নিশ্চয়ই নিজেদের দেশটিকেও ভারতের মতো, ভারতের সমকক্ষ দেখতে চান। তারা নিশ্চয়ই সেই দেশের বুকে অন্তত সামরিক শাসন চান না।কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক এবং শাসনতান্ত্রিক যে হাল বোঝ যাচ্ছে, তাতে আপাতত ইমরানের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা নেই নির্বাচনি প্রতীক হারিয়েছে ইমরানের দল পিটিআই। দলীয় নেত কর্মীরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। সভা-সমাবেশ বন্ধ। এককথায় দলটিকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, নয়তো সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠদের নানান পদে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার পিটিআই যতই দমন-পীড়নের শিকার হোক, শহুরে তরুণ ও মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে পাঞ্জাব এবং খাইবার পাখতুনখাওয়ার তরুণেরা এখনও পিটিআইকেই প্রতিষ্ঠানবিরোধী শক্তি বলে মনে করেন। পাকিস্তানের ভেতরের অস্থিরতা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছে, যেখানে পররাষ্ট্রনীতি নেই বরং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া-নির্ভর হয়ে পড়েছে। ভারতের জন্য এর অর্থ হলো, পাকিস্তান এখন শুধু একটি দুর্বল দেশ নয়, বরং এটি একটি অনিশ্চয়তার দেশ।ইমরানের দলকে দমন করে রাখার পেছনে রয়েছেন ‘পাকিস্তান প্রথম চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ আসিম মুনির। ইমরানের বিরুদ্ধে তার অবস্থান কঠোর। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কঠিন।-পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি- সব কিছু একাই নিয়ন্ত্রণ করেন। শাহবাজ শরিফ এমন এক জনসমর্থনে সরকার চালাচ্ছেন যা জনগণের উচ্ছ্বাস থেকে নয়, বরং সেনাবাহিনীর কৌশলগত প্রয়োজন থেকে এসেছে। তিনি নির্বাচিত নেতার মুখোশ পরে বাস্তবে সেনাপ্রধানের নির্দেশনায় হাঁটছেন। মুনির-শাহবাজের এই সমঝোতা আবার ভেতরে-ভেতরে ভঙ্গুর। কারণ পাকিস্তানের অর্থনীতি ঋণে জর্জরিত, আইএমএফের কঠোর শর্তে নিঃশেষ, আর প্রবৃদ্ধি খুবই কম। বাইরের দিকেও পাকিস্তানের সমস্যা বাড়ছে আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক দ্রুত খারাপ হয়েছে। এদিকে ভারত কাবুলের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়িয়েছে। এটিও পাকিস্তানের জন্য এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে। চিন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপেক) এখনও পাকিস্তান-চিন সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু। তবে চিন এখন অনেক বেশি সতর্ক এবং শর্তসাপেক্ষ। অন্যদিকে আমেরিকা পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে মূলত সন্ত্রাসবাদবিরোধী সহযোগিতা এবং কৌশলগত কারণ থেকে। ওয়াশিংটনে শাহবাজ ও মুনিরের যৌথ উপস্থিতি থেকে বোঝা যাচ্ছে, এই সম্পর্ক সহযোগিতামূলক হলেও পুরোপুরি লেনদেননির্ভর।বিষয়টি যে নির্ভরতা থেকেই হোক,নয়াদিল্লীর জন্য অস্বস্তি তৈরি করেছে।এই পুরো ছবিতে সৌদি আরবও একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে কাজ করছে। বহু বছর ধরে সৌদি আরব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ত্রাতা হিসেবে কাজ করেছে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর, পরিকাঠামো, মসজিদ, মাদ্রাসায় সৌদির অবদান আছে। এখনও তারা তেল মূল্য পরিশোধ সুবিধা সহ রাজনৈতিক দিক থেকেও পাকিস্তানকে রক্ষা করে। মুনির ও শাহবাজের জন্য সৌদির সমর্থন অত্যন্ত জরুরি। এটা না থাকলে আইএমএফের সঙ্গে শর্ত আরও কঠিন হতো। কিন্তু একই সময়ে সৌদি আরবের ভারতের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা প্রমাণ করে, পাকিস্তান আর আগের মতো সহজে সৌদির বন্ধুত্বের ওপর ভরসা করতে পারে না। এই কূটনৈতিক পরিস্থিতি সরাসরি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে। পহেলগাঁও এর পর পাকিস্তানভিত্তিক গোষ্ঠীর ওপর ভারতীয় হামলা, পাকিস্তানের পাল্টা আঘাত এবং তারপর যুদ্ধবিরতি-সব মিলিয়ে এক কঠিন নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখন এই অঞ্চলে সীমিত সামরিক সংঘর্ষ, ড্রোন যুদ্ধ, ক্ষেপণাস্ত্রভিত্তিক প্রতিরোধ- সবকিছুই কিন্তু পারমাণবিক হুমকির ছায়ার সঙ্গে পাশাপাশি চলছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *