ঘর ভাঙছে বিজেপির,পাহাড়ে একটিই রাজনৈতিক দল থাকবে ‘তিপ্রা মথা’: প্রদ্যোত!!
উদযাপন কথা
আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস বিশ্বজুড়ে আনুষ্ঠানিকতা, আন্তর্জাতিক শুভেচ্ছা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কিছু ফটো অপ, কিছু প্রতীকী সম্মান, সাহায্যসামগ্রীর প্যাকেট। প্রতিবছর একই ছবি। অথচ প্রতিবন্ধী মানুষদের জীবনে এই প্রতীকী আয়োজনের একবিন্দু প্রভাবও পড়ে না। রাষ্ট্র, কর্পোরেট এবং প্রশাসন- সবাই মিলে বছরের একদিনের আবেগ দিয়ে পুরো বছরের অবহেলা ঢাকতে অভ্যস্ত। এই ভন্ডামিকে আড়াল করার ভাষাই হলো ‘উদ্যাপন’।
১৯৯২ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ৩ ডিসেম্বর দিবসটি ঘোষণা করেছিল যে, প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি হবে মূল অগ্রাধিকার। কিন্তু তিন দশক পরেও বাস্তব ছবিটা স্পষ্ট – প্রতিবন্ধী মানুষ আজও সমাজের তলায় ঠেলে রাখা এক ‘দর্শকবঞ্চিত’ জনসমষ্টি। দলিত, আদিবাসী, নারী, শ্রমিক- প্রান্তিকতার প্রতিটি স্তর যেখানে সক্রিয়, সেখানে প্রতিবন্ধী মানুষ প্রান্তিকতার বহুগুণ ভার বইতে বাধ্য হন। আর এই অবস্থাকে তৈরি রেখেই রাষ্ট্র আবার দিবস পালন করে দায় সারে। এই বছরের থিম- ‘প্রতিবন্ধী-অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা’। শব্দটা আকর্ষণীয়, কিন্তু এর ভেতরে রাষ্ট্র কি সত্যিই সেই কাঠামো ভাঙার সাহস রাখে- যে কাঠামো প্রতিবন্ধকতার জন্ম দেয়? নাকি এই থিমও কেবল একটি কাগুজে শপথ, যেখানে বাস্তব নীতি, বাজেট, কর্মসূচি, জনপরিকাঠামো ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনও পরিবর্তন নেই?
UNCRPD কিংবা RPD Act আইনগুলো নিঃসন্দেহে দরকারি, কিন্তু তারা যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে না, সেটাই মূল সমস্যা। পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা যেখানে মানুষকে লাভ না হলে অদৃশ্য করে দেয়, সেখানে প্রতিবন্ধী মানুষ তো প্রথম সারির বলি। শিক্ষা, কর্মসংস্থান, চলাচল, স্বাস্থ্য- সব ক্ষেত্রেই তাদের জন্য বাধা তৈরি হয় কারণ সমাজের ভিত্তি থেকেই তারা ‘অপ্রয়োজনীয়’, ‘অপ্রযুক্ত’, ‘অদৃশ্য’ হিসাবে গণ্য। কিন্তু রাষ্ট্রসংঘ পরিচালিত পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন মন্ত্রক MOSPI নিজেই বলছে, প্রতিবন্ধী মানুষ বহুগুণ বঞ্চনার শিকার – বেশি দারিদ্র, কম সাক্ষরতা, বেশি বেকারত্ব। আর এই বহুবঞ্চনার মাত্রা আরও তীব্র হয় জাত, লিঙ্গ, ধর্ম, গ্রাম-শহর বৈষম্য এবং শ্রেণীগত নিপীড়নের কারণে। একজন দলিত প্রতিবন্ধী নারী – তিনি শুধু শরীরের সীমাবদ্ধতাই নয়, তিন স্তরের নিপীড়ন বইতে বাধ্য -জাতিভেদ, লিঙ্গবাদ এবং প্রতিবন্ধকতা। এই ব্যবস্থাজনিত বঞ্চনা কোনো দুর্ঘটনা নয়; এটি নির্মিত, পরিকল্পিত এবং ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার জন্যই স্থায়ীভাবে ধরে রাখা। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে দেশে ২ কোটি ৬৮ লক্ষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ছিলেন(জনসংখ্যার ২.২১ শতাংশ)। এই সংখ্যা বিভিন্ন কারণে বিতর্কিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুমান করে যে বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ বা প্রতি ছয় জনের মধ্যে একজন উল্লেখযোগ্যভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। জনগণনার পরিসংখ্যান এবং জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার অনুমান – এই দুটিতেই এটা স্পষ্ট যে, দরিদ্র অঞ্চল এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিবন্ধকতার প্রকোপ বেশি। MOSPI এর মতে, ভারতের ১৯ কোটি ৩০ লক্ষ পরিবারের মধ্যে ১০ শতাংশ (কম-বেশি) পরিবারে একজন বা তার বেশি প্রতিবন্ধী সদস্য থাকার খবর পাওয়া যায়। ভারতের জনগণনার সংখ্যা (২.২১%) নিছক রসিকতা – কারণ WHO-র হিসাব বলছে, প্রতি ছ’জনের একজন উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি। তো পার্থক্য এত ব্যাপক কেন? কারণ রাষ্ট্রের কাছে প্রতিবন্ধী মানুষ সংখ্যায় বেশি হলে দায়-দায়িত্বও বেশি হবে। পরিসংখ্যান কমিয়ে রাখাই রাষ্ট্রের সুবিধা।
এখন প্রশ্ন- একটি সমাজে প্রতিবন্ধী মানুষ কেন দারিদ্রের শিকার হন? কেন চাকরি পান না? কেন স্কুল-কলেজে পৌঁছাতে পারেন না? কেন ফুটপাথ কিংবা বাস-ট্রেন তাদের জন্য বিপজ্জনক? উত্তর একটাই কারণ সমাজ, রাষ্ট্র ও বাজার মিলে যে কাঠামো তৈরি করেছে, তাতে প্রতিবন্ধী মানুষের উপস্থিতি অগ্রহণযোগ্য। তাই নীতি হয়, কিন্তু তার বাস্তব প্রয়োগ হয় না। বরং উন্নয়নের নামে ঝকঝকে প্রকল্প দাঁড়ায়, কিন্তু সেগুলো হয় চওড়া গেট, সরু পদক্ষেপ – যেখানে প্রতিবন্ধী মানুষের প্রবেশাধিকার বিলাসিতা বলে গণ্য। সামাজিক সুরক্ষা যেমন স্বাস্থ্যসেবা, আবাসন, পেনশন, শিক্ষা, ইউনিভার্সাল ডিজাইন এসব কেবল কল্যাণমূলক কর্মসূচি নয়; এগুলো রাষ্ট্রের ন্যূনতম দায়িত্ব। কিন্তু ভারতে এগুলোকে দান হিসাবে দেওয়া হয়, অধিকার হিসাবে নয়। ফলে প্রতিবন্ধী মানুষ রাষ্ট্রের দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন- যা নিজেই একটি কাঠামোগত নিপীড়ন।
এ অবস্থায় প্রতিবন্ধী আন্দোলনকে কেবল নিজের দাবিতে আবদ্ধ থাকলে চলবে না। বরং এটি হতে হবে বৃহত্তর শোষণ বিরোধী লড়াইয়ের অংশ। শ্রমিকদের লড়াই, কৃষকের লড়াই, দলিত ও নারীমুক্তির লড়াই – এ সবের সঙ্গে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগ্রাম একই মাটির উপর দাঁড়িয়ে। কারণ শোষণের মূল ভিত্তি একটাই ক্ষমতা ও সম্পদের বৈষম্যমূলক বন্টন। প্রতিবন্ধী মানুষের স্বনির্ভরতা মানে শুধু যন্ত্র বা সুবিধা পাওয়া নয়;বরং সংগঠিত হওয়া, আন্দোলন গড়ে তোলা এবং সেই শোষণমূলক ক্ষমতার কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করা যা প্রতিবন্ধী মানুষদের সামাজিক অদৃশ্যতায় ঠেলে রাখে। অতএব, ৩ ডিসেম্বর যদি কেবল অনুষ্ঠানের দিন হয় – তাহলে এটি প্রতারণা। ৩ ডিসেম্বর হওয়া উচিত ঘোষণা যে সমাজ প্রতিবন্ধী মানুষদের মর্যাদা দেয় না,সে সমাজ উন্নত নয়; সে সমাজ-ন্যায্য নয়; সে সমাজ সভ্যও নয়।
অগ্রগতি কেবল GDP-র সংখ্যায় হয় না; প্রকৃত অগ্রগতি মাপা হয় সেই মানুষের জীবনে – যাদের সমাজ সবচেয়ে দুর্বল করে রেখেছে।সুতরাং আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস হওয়া উচিত ক্ষোভের দিন, দাবি তোলার দিন, শোষণ-বিরোধী সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার দিন। ন্যায়বিচারের জন্য কোনো আপস নয়। অন্তর্ভুক্তির নামে প্রতীকী আয়োজন নয় বরং কাঠামো বদলের আন্দোলন।
প্রতিবন্ধী মানুষের অন্তর্ভুক্তি মানেই সমাজের পুনর্গঠন – শুধু ভবন বা ফুটপাথ নয়, চাই অর্থনীতি, প্রশাসন এবং ক্ষমতার কাঠামোতেও মৌলিক রূপান্তর।