November 3, 2025

ইসরোর বাহুবলী বয়ে নিয়ে গেলো ৪৪১০ কিলো স্যাটেলাইট!!

 ইসরোর বাহুবলী বয়ে নিয়ে গেলো ৪৪১০ কিলো স্যাটেলাইট!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার মুকুটে একটি নতুনভপালক যুক্ত হলো রবিবার।ভারী উপগ্রহ উৎক্ষেপণে আত্মনির্ভরতার দিশা অন্বেষণ করে সফলতা পেলেন দেশের বিজ্ঞানীরা।এ কোনো ছোটখাটো অর্জন নয়।দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত নয়া প্রজন্মের বাহুবলী রকেটে চাপিয়ে মহাকাশে প্রেরণ করা হলো এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভারী যোগাযোগ উপগ্রহ। সবচেয়ে বড় কথা বিদেশ নয়, দেশের মাটি থেকেই এই উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।যোগাযোগ উপগ্রহটির নাম সিএমএস-০৩।এর ওজন ৪৪১০ কিলোগ্রাম।অন্যদিকে রকেটটির নাম এলভিএম ৩-এম ৫। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা এই বিরল সাফল্য অর্জন করে।সিএমএস-০৩ একটি মাল্টি ব্যান্ড কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট এবং ভারতীয় উপমহাদেশসহ তৎসংলগ্ন সামুদ্রিক অঞ্চলের উপর পরিষেবা প্রদান করবে। রবিবারের পূর্বে ফ্রেঞ্চ গুয়েনার কাওরাও লঞ্চ বেস থেকে ফ্রান্সভিত্তিক আরিয়ান স্পেসর আরিয়ান রকেটের সাহায্যে ভারী উপগ্রহ উৎক্ষেপণের কাজ সারত ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো। ২০১৮ সালের পাঁচ ডিসেম্বর আরিয়ান ৫ ভি এ-২৪৬ রকেটে চাপিয়ে ফ্রেঞ্চ গুয়েনা থেকে ইসরো তার সবচেয়ে ভারী যোগাযোগ উপগ্রহ জিস্যাট-১১-কে মহাকাশে পাঠিয়েছিল। ওই উপগ্রহটির ওজন ছিল ৫৮৫৪ কিলোগ্রাম। এই ধরনের ভারী উপগ্রহ মহাকাশে পাঠানোর মতো শক্তিশালী রকেট আগে ভারতের – কাছে ছিল না। কিন্তু এলভিএম ৩-এম ৫ সেই শূন্যতা পূরণ করেছে। রবিবার নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে সিএমএস ০৩ উপগ্রহটিকে। একে বলা হয় জিওসিনক্রোনাস ট্রান্সফার অরবিট। ইসরোর চেয়ারম্যান ভি নারায়ণন জানান, এই উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছে। ওই সময় তিনি এলভিএম রকেটটিকে বাহুবলী বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি স্মরণ করে বলেন,এই রকেটটি অতীতে ভারতের মর্যাদা ও গর্বের প্রতীক চন্দ্রায়ন ৩ মিশনে অংশগ্রহণ করেছে। এখন এটির পে লোড ক্যাপাবিলিটি অনেক বেড়ে গিয়েছে। এলভিএম ৩ সিরিজের রকেটগুলো এখন পর্যন্ত মোট আটটি অভিযানে অংশগ্রহণ করেছে।সাফল্যের খতিয়ান একশ শতাংশ। সর্বশেষ যে সিএমএস ০৩ উপগ্রহটি ওই রকেটে চাপিয়ে মহাকাশে পাঠানো হয়েছে সেটি কমপক্ষে পনেরো বছর যোগাযোগ পরিষেবা প্রদান করবে। আত্মনির্ভর ভারত গড়ার ক্ষেত্রে যা একটি উজ্জ্বল নিদর্শন বলে মন্তব্য করেন কে নারায়ণন। প্রসঙ্গত রবিবার উৎক্ষেপণের আগে ইসরোর নিখানীদের কঠোর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় তাদেরকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। কিন্তু কঠোর শ্রম এবং অধ্যবসায় তাদের সাফল্য নিশ্চিত করে। এলভিএম ৩-এম ৫ একটি ত্রিস্তরীয় উৎক্ষেপণ যান। এর রয়েছে দুটি সলিড মোটর স্ট্রেপ অনস (এস ২০০), একটি লিকুইড প্রোপেলান্ট কোর স্টেজ (এল ১১০) এবং একটি ক্রায়োজেনিক স্টেজ (সি ২৫)। রকেটের দুই পাশে অবস্থিত দুটি এস ২০০ সলিড রকেট বুস্টার উৎক্ষেপণের সময় প্রয়োজনীয় বল প্রদান করে থাকে। দুটি রকেট বুস্টার তৈরি করা হয়েছে বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টারে। এই প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা ইসরোকে জিওসিনক্রোনাস ট্রান্সফার অরবিটে ভারী উপগ্রহ প্রেরণের ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। এলভিএম ৩-এম ৫ রকেটকে ইসরোর বিজ্ঞানীরা তার সক্ষমতা ও সফলতার নিরিখে জিওসিনক্রোনাস স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল নামেও অভিহিত করে থাকেন। আসলে অভিযানের লক্ষ্য, নির্দিষ্ট কক্ষপথ, কাঙ্খিত উচ্চতা সহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে উৎক্ষেপণ যানগুলির শ্রেণীবিন্যাস করে থাকেন বিজ্ঞানীরা। এখন পর্যন্ত যে রকেটগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল (পিএসএলভি), জিএসএলভি এবং সর্বশেষ এলভিএম ৩ (লঞ্চ ভেহিকেল মার্ক III)। শ্রীহরিকোটা থেকে ১৯৯৯ সাল থেকেই গ্রাহকদের ‘উপগ্রহ উৎক্ষেপণ পরিষেবা’ প্রদান করছে ইসরো। এখন পর্যন্ত পিএসএলভির সাফল্যের খতিয়ান ঈর্ষণীয়। এই মহাকাশযানের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল ছিল ভারতের বিজ্ঞানীরা। এটি ১৭৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত পে লোড বহন করতে সক্ষম। আপার স্টেজ ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিন সহ জিএসএলভি রকেটগুলো আরও বেশি ভারী উপগ্রহ বহন করতে সক্ষম। এগুলি ২২০০ কিলোগ্রাম ওজনের উপগ্রহও বহন করতে পারে। আর এখন এলভিএম ৩ রকেটগুলো ৪০০০ কিলোগ্রামের বেশি পে লোড বহন করতে সক্ষম। লো আর্থ অরবিটের ক্ষেত্রে এটি ৮০০০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত পে লোড বহন করতে পারে। রবিবারের মিশনটি তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এই প্রথম ভারতের মাটি থেকে এত ভারী ধরনের উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করা হলো দেশীয় প্রযুক্তিতে নির্মিত কোনো রকেটের সাহায্যে। এলভিএম ৩-এম ৫ টি ছিল পঞ্চম অপারেশনাল ফ্লাইট। এই রকেট সম্পূর্ণ ঘরোয়া প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সি ২৫ ক্রায়োজেনিক স্টেজও রয়েছে। এখন পর্যন্ত এলভিএম থ্রি রকেটগুলোর ট্র্যাক রেকর্ড সর্বোত সাফল্যমণ্ডিত। ভারতের উচ্চাভিলাষী গগনযান মিশনের জন্য এই রকেটটি ব্যবহারের পরিকল্পনা করে রেখেছে ইসরো এবং এর নাম দেওয়া হয়েছে এইচআরএলভি।
ভারতের মাটি থেকে সবচেয়ে ভারী যোগাযোগ উপগ্রহের সফল উৎক্ষেপণের জন্য রবিবার ইসরো বিজ্ঞানীদের অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং উপ-রাষ্ট্রপ্রতি মিপি রাধাকৃষ্ণশ।
ইসরো একটি এলভিএম-৩ রকেট ব্যবহার করে ৪,৪১০ কেজি ওজনের সিএমএস-০৩ উপগ্রহটি জিওসিনক্রোনাস ট্রান্সফার অরবিটে (জিটিও) স্থাপন করার পরপরই প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য আসে।”আমাদের মহাকাশ খাত আমাদের গর্বিত করে চলেছে। ভারতের সবচেয়ে ভারী যোগাযোগ উপগ্রহ সিএমএস-০৩-এর সফল উৎক্ষেপণের জন্য ইসরোকে অভিনন্দন” জানিয়ে এক্স-তে পোস্ট করেছেন মোদি।
উপগ্রহটিকে কাঙিক্ষত কক্ষপথে স্থাপন করার পাশাপাশি, ইসরো বিজ্ঞানীরা সি-২৫ ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিনটি কক্ষপথে স্থাপন করার পরে এর থ্রাস্ট চেম্বারের পুনঃপ্রজ্বালনও প্রদর্শন করেছেন।এই পরীক্ষাটি ইসরোকে ক্রায়োজেনিক পর্যায় পুনরায় চালু করতে সাহায্য করবে এবং বিভিন্ন কক্ষপথে উপগ্রহ স্থাপনের নমনীয়তা দেবে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের মহাকাশ বিজ্ঞানীদের দ্বারা চালিত হয়ে, আমাদের মহাকাশ খাত কীভাবে উৎকর্ষতা এবং উদ্ভাবনের সমার্থক হয়ে উঠেছে তা প্রশংসনীয়। তাদের সাফল্য জাতীয় অগ্রগতিকে আরও এগিয়ে নিয়েছে এবং অসংখ্য জীবনকে ক্ষমতায়িত করেছে।উপগ্রহ উৎক্ষেপণের প্রশংসা করে উপরাষ্ট্রপতি বলেন, ইসরো মহাকাশ অনুসন্ধানে উল্লেখযোগ্য মাইলফলক অর্জন করে চলেছে। তিনি বলেন, ‘ইসরো এবং ভারতীয় নৌবাহিনীকে আন্তরিক অভিনন্দন! ভারতের শক্তিশালী এলভিএম ৩-এম ৫ রকেট আবারও আকাশে উড়ে গেলো, ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য সবচেয়ে ভারী এবং উন্নত যোগাযোগ উপগ্রহ জিএসএটি-৭আর (সিএমএস-০৩)-জিওসিনক্রোনাস ট্রান্সফার অরবিটে স্থাপনের সফল উৎক্ষেপণের মাধ্যমে’।তিনি আরও বলেন, এই দেশীয়ভাবে তৈরি উপগ্রহটি ভারত মহাসাগর অঞ্চলে মহাকাশভিত্তিক যোগাযোগ, সংযোগ এবং সামুদ্রিক ক্ষেত্র সচেতনতা জোরদার করবে, যা আত্মনির্ভর ভারতের আরেকটি গর্বিত মাইলফলক চিহ্নিত করবে।ইসরো চেয়ারম্যান ভি নারায়ণন বলেছেন, মহাকাশ সংস্থা আগামী পাঁচ মাসে সাতটি উৎক্ষেপণ মিশন পরিচালনা করার পরিকল্পনা করেছে।ইন্ডিয়ান স্পেস অ্যাসোসিয়েশন (আইএসপিএ) -এর মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল একে ভাট (অবসরপ্রাপ্ত) বলেছেন যে সিএমএস-০৩ স্যাটেলাইট ভারতের সামুদ্রিক ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে, যা ভারত মহাসাগর অঞ্চল এবং মূল ভূখণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ উন্নত, নিরাপদ যোগাযোগ চ্যানেল সরবরাহ করবে।’ইসরোর উৎক্ষেপণ কেবল আমাদের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনকেই শক্তিশালী করে না, বরং আমাদের দেশের মহাকাশ সম্পদ নির্মাণ ও সমর্থনে বেসরকারী শিল্পের অংশগ্রহণের জন্য একটি প্রাণবন্ত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়, যা একটি শক্তিশালী মহাকাশ শক্তি হিসাবে আমাদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে’, বলেন ভাট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *