August 6, 2025

আত্মবিস্মৃত বাঙালি!!

 আত্মবিস্মৃত বাঙালি!!

বিশিষ্ট চিন্তাবিদ,সুনিপুণ লেখক এবং স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন ইতিহাসবেত্তা রূপে দেশে বিদেশে পরিচিত মুখ নীরদ সি চৌধুরী তাঁর নিজের সারাজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে অনেকগুলোর মধ্যে একটা বিখ্যাত গ্রন্থ লিখে গিয়েছিলেন।বইটির নাম ‘আত্মঘাতী বাঙালি’।অত্যন্ত তুখোড় বিশ্লেষণ, সামাজিক রীতি-নীতি, মানুষের চিন্তা-চেতনা বাঙালি-সংস্কৃতি এবং আচার আচরণকে ভিত্তি করে আমাদের বিন্দু বিন্দু অসামঞ্জস্যগুলো। বিশেষ করে নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার চেষ্টা করে গেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, আমাদের যা কিছু দুর্ভাগ্য, মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়া, অপুষ্টি, মান-সম্মানে ঘাটতি- তার জন্য কেউ পেছন থেকে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে না। আমাদের মূল সমস্যার জায়গাটি হলো, আমরা আত্মঘাতী বাঙালি। ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস আমাদের ভাবায়, ইতিহাস আমাদের তাড়িত করে। প্রতিদিনের কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনাই স্থান পায় ইতিহাসে। ইতিহাসের সেই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো যখন পরবর্তী সময়ে আবার আমাদের জীবনে অভিশাপ কিংবা আশীর্বাদ হয়ে ফিরে আসে, ইতিহাসের সেই পুনরাবৃত্তির মুহূর্তগুলোকে উদ্যাপন করতে, স্মরণ করতে, আবার স্মৃতিকে ঝালিয়ে নিতে অতীতকে ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে খুঁজে বার করি। কখনও তা নিয়ে হাপিত্যেশ করি। কিন্তু অতীতের ইতিহাস থেকে নিজেদেরকে সংশোধনের কাজটা আমরা করি না। ইতিহাস তথা স্মৃতিতে জমে থাকা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এমনই একটি পরিস্থিতি আজ ততটাই প্রাসঙ্গিক হয়ে ফিরে এসেছে আমাদের জীবনে। বিষয়টা হলো বাংলা ভাষা ও বাঙালি। ভারতের সংবিধানের অষ্টম তফশিলে বাংলা সহ মোট ২২ টি ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ১৯৫০ সাল থেকে বাংলা ভারতের সাংবিধানিক স্বীকৃত ভাষা। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর থেকে বাংলা ভাষাকে ভারত সরকার ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদাও দিয়েছে। এর অর্থ হলো, বাংলা শুধুমাত্র প্রচলিত একটি ভাষাই নয়, বরং ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক দিক থেকে এ এক অমূল্য সম্পদ। অথচ বাংলা ভাষা নিয়ে যিনি হালে বিতর্ক জন্ম দিয়েছেন তিনি বিজেপি আইটি সেলের মাথা অমিত মালব্য। তার মতে-বাংলা বলে কোন ভাষা নেই। মনে রাখতে হবে যিনি একথাটা বলেছেন, তিনি সাধারণ কেউ নন।বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অন্যতম এক মুখ।তাই একে শুধুই রাজনৈতিক বক্তব্য ভাবা ঠিক হবে না। এ হচ্ছে একটি সংস্কৃতির ও জাতিসত্তার বিরুদ্ধাচরণ, কারণযে ভাষাকে মালব্য খারিজ করে দিচ্ছেন, সেই বাংলা ভাষাতেই লেখা ভারতের জাতীয় সঙ্গীত জনগণমন। যা রচনা করেছিলেন নোবেল জয়ী বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভারতের জাতীয় স্তোত্র বন্দেমাতরম যিনি রচনা করেছেন তিনিও একজন বাঙালি, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা ভাষা কেবলমাত্র ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই সীমিত নয়। মধ্যপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, আসাম, ওড়িশা, মেঘালয় সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অগণিত মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। এছাড়া বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৩০ কোটির বেশি মানুষ প্রতিদিন বাংলা ভাষা ব্যবহার করেন। তাই বাংলার মতো ঐতিহ্যবাহী ভাষাকে যারা ভাষা মানতে চান না, বুঝতে হবে একথা বলা নিছক শুধু ভুল নয়, সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক অপচেষ্টা। একে ভাষা নিয়ে অজ্ঞতা মনে করা ভুল হবে। কার্যত এ হচ্ছে ভাষার মাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়ানোর আরেক অপকৌশল। হতে পারে হিন্দিকে যারা দীর্ঘদিন ধরে ভারতের মাথায় বসিয়ে রাষ্ট্রভাষা কিংবা প্রধান ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে- এ হলো তাদেরই এক ভিন্ন রূপ। ভারতের মতো দেশে যেখানে ২২টি ভাষা সমান মর্যাদা পায়, সেখানে বাংলা ভাষা নিয়ে শাসকের কোনো প্রতিনিধির মুখে এই ধরনের উক্তি, বহুভাষিক দেশে এক ভাষার আধিপত্য চাপিয়ে দেওয়ার ঘৃণিত এবং নিন্দনীয়প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। ভুলে গেলে চলবে না বাংলা কেবল একটি ভাষা নয়, বাংলা একটি সভ্যতা। রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল, মাইকেল মধুসূদন থেকে জীবনানন্দ, শরৎচন্দ্র- যারা বিশ্ব সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তারা সবাই বাংলার সন্তান। আসলে বাংলা ভাষাকে বাংলাদেশি তকমা দিয়ে যে বিপজ্জনক ও উস্কানিমূলক কাজ করেছে দিল্লী পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র দপ্তর, তখন বিজেপির আইটি সেলের কর্তা যখন এই অশালীনতা এবং হীনমন্যতার পক্ষে সাফাই গাইতে মাঠে নামেন, তখন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, পুরো পুতুল নাচের সুতো দক্ষ কারিগরের হাতেই বাঁধা। যুক্তি হিসাবে যখন বলা হয়, দিল্লী পুলিশ অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করতে ‘বাংলাদেশি ভাষা শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশি ভাষা বলতে তারা বোঝাতে চেয়েছে এমন এক ধরনের ভাষার রূপ, যার উপভাষা, ব্যাকরণ এবং উচ্চারগণত বৈশিষ্ট্য পশ্চিমবঙ্গের ভাষা থেকে আলাদা। তখন এটা আরও স্পষ্ট হয়ে যায় যে শাসকের মাথায় যখন ভাষাগত বর্ণবৈষম্য মাথাচাড়া দেয় তখনই তারা পরিকল্পিতভাবে বিভাজনের রাজনীতির লক্ষ্যে বাংলা ভাষা ও বাঙালিদেরকে কতটা অশ্রদ্ধা ও বৈরিতার চোখে দেখে। এটা শুধু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেই ঘটেনি। আগে দক্ষিণ ভারতের তামিল ও তেলেগু ভাষা ক্ষেত্রেও বৈরিতা লক্ষ্য করা গেছে। যদিও দক্ষিণ ভারত নিজেদের ভাষাগত মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায় বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে এবং ভাষাগত দখলদাররা লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। সমস্ত রাজনীতি ও পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে উঠে বাংলা ভাষা ও বাঙালির সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় দেশবিরোধী, অসাংবিধানিক, অপমানজনক এই স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেই হবে বাঙালিকে। গর্জে উঠতে হবে যে কোন ধরনের ভাষাগত অপমানের বিরুদ্ধে। কারণ ভুলে গেলে চলবে না যে, মাতৃভাষা হল মাতৃদুগ্ধ। যদি সেটা না হয় তবে ‘আত্মঘাতী বাঙালি’ বদনাম থেকে নিজেদের কখনও বাঁচাতে পারবে না আত্মবিশ্যত জাতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *