October 20, 2025

অর্থনৈতিক সন্ধিক্ষণ!!

 অর্থনৈতিক সন্ধিক্ষণ!!

বিশ্বায়নের ভাঙা দেয়ালে নতুন অর্থনৈতিক সমীকরণের যুদ্ধ শুরু হয়েছে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যে মুক্ত বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল; যেখানে পণ্য, পরিষেবা, মূলধন, এমনকী শ্রমও দেশ সীমানা পেরিয়ে অবাধে চলাচল করতো- সেই উদার বিশ্ব এখন ধীরে ধীরে নিজের দরজা বন্ধ করছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি আর চিনের স্বার্থপর বাণিজ্যনীতির যৌথ ফল; বিশ্বায়নের যে ভিতটা ভারতকে এক সময় টেনে তুলেছিল, সেটিই আজ কার্যত ধসে পড়ছে।
ভারতের আর্থিক উত্থানের গল্প শুরু হয়েছিল ১৯৯১ সালে, যখন দেশের নেতৃত্ব উপলব্ধি করেছিলেন যে, রক্ষণশীল নীতি শুধু গরিবিই নয়, স্থবিরতাও ডেকে আনে। দুই দশকে ভারতের অর্থনীতি চার গুণ বেড়েছিল। কিন্তু আজ সেই গতিপথে বিপদ। চকচকে জিডিপির অঙ্কে আমরা বিশ্বের দ্রুততম বৃদ্ধির হার সম্পন্ন দেশ এটা যেমন সত্য, তেমনই সত্য মাথাপিছু আয়ে আমরা বিশ্বের একশ আটটি দেশের পেছনে। অর্থাৎ মোট জিডিপির ঝলক থাকলেও গড়পড়তা ভারতীয়ের হাতে টাকায় তেমন পরিবর্তন আসেনি। এমতাবস্থায় যদি বিশ্বের দরজা বন্ধ হয়, ভারত কী করবে? অন্তর্মুখী হয়ে ‘আত্মনির্ভর’ স্লোগানেই কি সমাধান? ইতিহাস বলে; কোনো দেশ নিজের বাজারে তালা লাগিয়ে বড় হতে পারেনি। ১৯৯১-এর আগের ভারতই তার প্রমাণ। ফলে আমেরিকাকে দেখে ভারত যদি ফের রক্ষণশীল পথে হাঁটে, তাতে শুধু ক্ষতির ঘড়াই পূর্ণ হবে। তাই আজ ভারতের দরকার দৃষ্টি ফেরানো, তবে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। আমেরিকা বা চিনের মতো দুই বৃহৎ অর্থশক্তির মধ্যে আটকে না পড়ে, ভারতকে খুঁজতে হবে নতুন সঙ্গী। যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশ, যারা এখনও নিয়মভিত্তিক বাণিজ্যে বিশ্বাস রাখে। এরা রাজনীতির চেয়ে স্থিতিশীল এবং তাদের সঙ্গে ভারতের যোগসূত্র হলে সেটাই হতে পারে নতুন বৃদ্ধির ভিত্তি।
এই দিকেই ইতিমধ্যে কয়েকটি পদক্ষেপ হয়েছে।যেমন ব্রিটেনের সঙ্গে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা। এদিকে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই মুহূর্তে রাষ্ট্রীয় সফরে রয়েছেন ব্রাজিলের ডেপুটি প্রেসিডেন্ট, সে দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী-সহ উচ্চপর্যায়ের এক প্রতিনিধিদল। কিন্তু এগুলি কেবল সূচনা। ভারতের উচিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করা, যাতে এই দেশ বৈশ্বিক জোগান শৃঙ্খলের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠে। বিশ্বের বড় অর্থশক্তিগুলি এখন ‘রিসোর্স রিডিস্ট্রিবিউশন’-এর রাজনীতি করছে। ফলে ভারতের জায়গা তৈরি করতে হলে তাকে প্রমাণ করতে হবে, যে সে কেবল বাজার নয়, উৎপাদনেরও কেন্দ্র।
কিন্তু এই পথ সহজ নয়।উল্টে গত এক দশকে ভারত আবার ধীরে ধীরে রক্ষণশীল পথে ফিরেছে। গড় আমদানি শুল্ক দ্বিগুণ হয়েছে; ৬ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ। আমদানির পথে নানাবিধ অদৃশ্য বাধা তৈরি হয়েছে। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সঙ্কোচবোধ করেন, দেশীয় শিল্পও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। যে বিশ্বে প্রযুক্তি ও গতি-নির্ভর উৎপাদনই মুখ্য, সেখানে শুল্কের প্রাচীর তুলে ভারত নিজেই নিজের বাজার ছোট করছে। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত সংস্কার এখন সময়ের দাবি। ভারত এখনও অতি নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনিক জটিলতা ও বিচারবিলম্বের বোঝা বয়ে চলেছে। ‘লাল ফিতের’ এই ফাঁস কেটে যদি বেসরকারী উদ্যোগ, স্টার্টআপ ও উৎপাদন খাতে স্বাধীনতা না আসে, তবে বিদেশি বিনিয়োগ টিকবে না। শুধুমাত্র জিএসটি হার কমানো বা ট্যাক্স ছাড় নয়, প্রয়োজন নীতির স্বচ্ছতা ও প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা।
মূল কথা,আমেরিকা-বিরোধী অবস্থান নেওয়া আত্মঘাতী হবে। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ভারতীয় ছাত্র, আমেরিকায় থাকা ভারতীয় পেশাজীবী, মার্কিন প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ; সব মিলিয়ে দুই দেশের অর্থনীতি পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে। সম্পর্ক খারাপ হলে তার অভিঘাত সরাসরি পড়বে ভারতীয় পরিষেবা রপ্তানিতে। আসলে আজকের পরিস্থিতি অনেকটা ১৯৯১ সালের মতোই। তখন সংকট ছিল বৈদেশিক মুদ্রার, আজ সংকট বিশ্বাসের। তখন দরজা খুলে ভারত বাঁচিয়েছিল নিজের অর্থনীতি; আজ দরজা বন্ধ করলে আবারও ডুবে যেতে পারে।এখন সময়, সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার।এমন সিদ্ধান্ত, যা ভারতকে একুশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য প্রস্তুত করবে।আমলা তন্ত্রের আলস্য, নীতির দোদুল্যমানতা আর আত্মতুষ্টি ছেড়ে নতুন করে ভাবতে হবে; কারণ, অর্থনীতির এই নতুন কেমিস্ট্রিতে স্থায়ী সাফল্য পেতে গেলে ‘ফিজিক্সের অর্থনীতি’ নয়, দরকার হবে দূরদৃষ্টির রাজনীতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *