অন্য পথ!!
বিহারের রাজনীতি মানেই জাতপাতের রাজনীতি।এই সত্যটা এখন এতটাই অমোঘ যে,কোনও দলই তা এড়িয়ে চলতে পারে না।বিহার ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে এমন এক রাজ্য যেখানে জাতপাত শুধু পরিচয়ের রাজনীতি নয়,অস্তিত্বের প্রশ্ন।সেই রাজনীতিরই কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আবারও সমাসন্ন একটি বিধানসভা নির্বাচন। এনডিএ হোক বা মহাগঠবন্ধন, দুই শিবিরই অনিবার্যভাবেই জাতপাতের অঙ্ককে তাদের নির্বাচনি কৌশলের কেন্দ্রে রেখেছে। এই অঙ্কে উন্নয়ন, শিক্ষা বা স্বপ্ন সবই গৌণ। ভোটের হিসাব চলে জন্মপরিচয়ের ভিত্তিতে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশান্ত কিশোরের জন সুরাজ পার্টি যেন এক ধরনের বেমানান ব্যতিক্রম।
প্রশান্ত কিশোর,পিকে নামে যিনি অধিক পরিচিত। ২০১৪ সাল থেকে ‘ভোটকুশলী’ এটাই তার মূল পরিচয় ছিল। সেই জায়গা থেকে এবার বিহারে তিনি একটি দলের কর্ণধার। যদিও তিনি নিজে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না। জাতপাতের রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে কথা বরং তিনি বলছেন ভূমি সংস্কার, শিক্ষা, প্রশাসনিক সংস্কার এবং দুর্নীতিমুক্ত শাসনের। তার প্রচারে এমন সব বিষয় এসেছে, যেগুলির সঙ্গে বিহারের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন জড়িয়ে আছে। ভোটের সুবিধা হয়তো নেই, কিন্তু ভবিষ্যতের দিশা আছে। এই অবস্থানই প্রশান্তকে আলাদা করেছে বাকি দুই শিবির থেকে।
তবে বাস্তবতা অনেক কঠিন। বিহারে জাতপাত শুধু রাজনীতির ইস্যু নয়, সামাজিক কাঠামোর ভিত। যে জাতির মানুষ ভোট দেয়, তারাই নির্ধারণ করে প্রার্থী কার, সরকার কার। উন্নয়ন সেখানে গৌণ, পরিচয়ই মুখ্য। প্রশান্ত কিশোর সেই গাঢ় বাস্তবতাকে ভেঙে মধ্যবিত্ত ভাবনা ও উন্নয়নের স্বপ্নকে সামনে আনতে চাইছেন। তিনি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছেন- ‘ভাতা নয়, ব্যবস্থা চাই’। কিন্তু বিহারের ভোটার তাতে কতটা সাড়া দেবে সেটা অন্য প্রশ্ন।
জন সুরাজের গত কয়েক বছরের নির্বাচনি পরিসংখ্যান অন্তত আশাব্যঞ্জক নয়। ২০২৪ সালের উপনির্বাচনে পিকে-র পার্টি গড়ে দশ শতাংশেরও কম ভোট পেয়েছিল। ক্ষমতার দৌড়ে এই ফল নিরানন্দের। তবু প্রশান্ত কিশোরের কৌশলকে অবজ্ঞা করা ভুল হবে। তিনি আসরে এমন এক সামাজিক শ্রেণীকে লক্ষ্য করছেন, যারা নিম্নবিত্ত হলেও মধ্যবিত্ত হওয়ার স্বপ্নে বাঁচে। শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং আত্মমর্যাদার লড়াইয়ে যারা নতুন পথ খুঁজছে, তাদেরই প্রতিনিধি হতে চাইছেন তিনি।বিহার দীর্ঘদিন ধরে ভারতের দরিদ্রতম রাজ্যগুলির অন্যতম। মাথাপিচু আয়ে দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা রাজ্য। কিন্তু একই সঙ্গে এ রাজ্যে লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহও গভীর। এখন গ্রামীণ তরুণদের বড় অংশ কোচিং, অনলাইন প্রশিক্ষণ আর প্রতিযোগিতামুক পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য বদলাতে চাইছেন। তাদের কাছে জাতপাতের রাজনীতি এক মৃত অতীত। প্রশান্ত সেই মানসিক পরিবর্তনের উপরই বাজি ধরছেন। তবে তার রাজনীতি মধ্যবিত্ত আকাঙ্ক্ষার রাজনীতিও এবং এই শ্রেণী বিহারে এখনও সংখ্যালঘু। ‘ভাতার রাজনীতি’ তথা জনমোহিনী খয়রাতির রাজনীতি যে বাস্তবে কতটা কার্যকর, তা কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন রাজ্য সরকার, বিশেষত মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশের সাম্প্রতিক সাফল্যেই স্পষ্ট। নগদ অর্থের সরাসরি হস্তান্তর এখন ভোটারদের সঙ্গে সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী সেতু। প্রশান্ত কিশোর সেই জনপ্রিয় সেতু ভেঙে নতুন রাস্তা বানাতে চাইছেন। আদর্শবাদী উদ্যোগ সন্দেহ নেই, কিন্তু রাজনৈতিক ঝুঁকি ভয়ঙ্কর। কারণ, ময়দানী বাস্তবটা হলো বিহারে তারাই ভোট পায় যারা জাতের নামে কথা বলে, ভাতার নামে প্রতিশ্রুতি দেয়, আর দুর্নীতির প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যায়।
পিকের প্রতিশ্রুতিতে পেনশন আছে, কিন্তু প্রধান জোর দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, ভূমি সংস্কার, শিক্ষাব্যবস্থা। দুর্নীতি প্রশ্নে তিনি আক্রমণাত্মক, বলেছেন, ক্ষমতায় এলে একশোজন দুর্নীতিগ্রস্তকে আইনের আওতায় আনবেন। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, দুর্নীতি বিরোধী রাজনীতি কদাচিৎ ভোটবাক্সে লক্ষ্মীলাভ ঘটায়। সেটি মধ্যবিত্তের নৈতিক আবেগকে ছোঁয় ঠিকই, কিন্তু দরিদ্রের পেটের প্রশ্ন নয়। প্রশান্ত কিশোরের রাজনীতি তাই আপাতত ‘বিকল্প ভাবনার রাজনীতি’। হয়তো তারা এখনও ক্ষমতার বিকল্প নন, কিন্তু চিন্তার বিকল্প হয়ে উঠেছেন। বিহারের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যেখানে জাতপাত ও ভাতার প্রলোভনই একমাত্র মুদ্রা, সেখানে তিনি ফিরিয়ে আনছেন দায়িত্ব, স্বপ্ন ও নীতি- এমন এক রাজনীতির পরিভাষা, যা ভারতের গণতন্ত্র বহুদিন ভুলে গেছে।তবু প্রশ্ন থেকে যায়, বিহার কি সেই ভাষা বোঝার মতো প্রস্তুত?জাতপাতের রাজনীতি, ভাতার রাজনীতি, আর মধ্যবিত্তের আকাঙ্ক্ষার রাজনীতি, এই তিনের সংঘাতে দাঁড়িয়ে আছে প্রশান্ত কিশোরের জন সুরাজ। ফলাফল যাই হোক না কেন, তার এই উদ্যোগ ভারতের রাজনীতিতে এক নতুন কথোপকথন, অন্য পথের নির্মাণ শুরু করেছে। হয়তো এই ‘অন্য পথ’ থেকেই আসবে ভবিষ্যতের পরিবর্তনের বীজ।