অনলাইন প্রতিনিধি :-রাজ্যে এই প্রথম চাকরি থেকে ইস্তফা দিলেন কোনও বিডিও। ব্লকে কাজের কোনও পরিবেশ নেই তাই চাকরি থেকে ইস্তফা দিলেন কাঞ্চনপুর মহকুমার লালজুরি আর ডি ব্লকের বিডিও। উত্তর জেলার প্রশাসনিক যন্ত্রে ক্রমশ জমে ওঠা অস্থিরতার মধ্যেই লালজুরি আর ডি ব্লকের বিডিও ময়ুখ দত্ত মজুমদারের ইস্তফা রাজ্য প্রশাসনের উপর এক তীব্র আঘাত হিসেবে সামনে এসেছে। দুর্নীতির পাহাড় চাপা পরিবেশে সৎ ও নীতিনিষ্ঠ আধিকারিকরা যে আর কাজ করার মতো পরিস্থিতি পাচ্ছে না, বিডিও ময়ুখ দত্ত মজুমদারের সিদ্ধান্ত তা আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। দীর্ঘদিন ধরে লালজুরি ব্লকে চলতে থাকা সীমাহীন অনিয়ম, বেআইনি আর্থিক লোপাট ও বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দ নিয়ে অসাধু চক্রের দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেছিলেন। কিন্তু সেই লড়াইয়ে তিনি পাননি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সমর্থন কিংবা সুরক্ষা। বরং নীরবতা ও দায় ঝেড়ে ফেলার প্রবণতাই ছিল প্রশাসনের স্বভাবসিদ্ধ প্রতিক্রিয়া। শেষ পর্যন্ত নিজের সততা ও সম্মান রক্ষার প্রয়োজনে তিনি বাধ্য হলেন চাকরি ছাড়তে। বিডিও ময়ুখ দত্ত মজুমদার সোমবার তার ইস্তফাপত্র সরাসরি পাঠিয়েছেন উত্তর জেলার জেলাশাসক চাঁদনী চন্দ্রনের কাছে। এই পদক্ষেপ সামনে আসতেই গোটা জেলার প্রশাসনিক পরিসরে শুরু হয়েছে শোরগোল। কারণ এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গত কয়েক মাস ধরেই উত্তর জেলায় একের পর এক দপ্তরে দুর্নীতি এবং অসাধু চক্রের আধিপত্য নিয়ে অভিযোগ উঠছিল। দুর্গাপুজোর ব্যয়ের হিসেব থেকে শুরু করে ফিফটিন ফাইন্যান্সের বরাদ্দ সব ক্ষেত্রেই অসংগতি ও আর্থিক কারসাজির ধারবাহিকতা প্রকাশ্যে এসেছে। ‘দৈনিক সংবাদ’এ এই কেলেঙ্কারিগুলির ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশের পর প্রশাসন কার্যত নড়ে উঠলেও বাস্তবে কোনও কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং অভিযুক্ত চক্রের মাথাদের উপর অদৃশ্য সুরক্ষা-ছাতা আরও মজবুত হয়েছে।
বিডিও ময়ুখ দত্ত মজুমদার দুর্নীতিবাজ কয়েকজন পঞ্চায়েত সচিবের বিরুদ্ধে রিপোর্ট জমা দিলেও, সেই রিপোর্টের জায়গা হয়েছে ফাইলের গহিন অন্ধকারে। যেখানে সত্যকে চেপে রাখাই যেন প্রশাসনের অলিখিত নিয়ম। অবশেষে তিনি উপলব্ধি করেন- এই অবস্থায় দায়িত্ব পালন করা মানে নিজের নীতি নৈতিকতা ও আত্মসম্মানকে বারবার বিসর্জন দেওয়া। তাই সিস্টেমের কাছে মাথা নত না করে তিনি সসম্মানে বিদায় নেওয়ার পথ বেছে নেন।
এই ইস্তফা শুধু একজন আধিকারিকের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নয়,এটি রাজ্য প্রশাসনের প্রতি ভয়াবহ অগ্নি সংবাদ। জানা গেছে, উত্তর জেলার বিভিন্ন ব্লকের আরও কয়েকজন আধিকারিক আগেই জানিয়েছেন যে চাপিয়ে দেওয়া দুর্নীতিমূলক কাজ তারা করবেন না। লালজুরি আর ডি ব্লকের বিডিও ময়ুখ মজুমদারের ইস্তফা তাদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। উত্তর জেলা দীর্ঘদিন ধরেই ‘দুর্নীতির আঁতুড়ঘর’ হিসেবে পরিচিত। ইতিমধ্যে কাঞ্চনপুর ডি ডব্লিউ এস দপ্তরের নির্বাহী বাস্তুকার অনিমেষ দাস একই কারণে চলতি বছরেই ইস্তফা দিয়েছেন। দুর্নীতির কাছে মাথা না নোয়ানো আধিকারিকদের যখন দপ্তর রক্ষার পরিবর্তে বারবার একঘরে করা হয়, তখন স্পষ্ট বোঝা যায়- সিস্টেম নিজেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। একজন সৎ ও কর্মঠ আধিকারিককে কোনও রকম সুরক্ষা না দিয়ে বরং চারদিকে চাপ সৃষ্টি করা হয়। তবে দুর্নীতিকারীরা এত সাহস পায় কোথা থেকে? প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে সক্রিয় অসাধু চক্র কি তাহলে সরকারের ছায়াতলে নিরাপদ? এই ঘটনা রাজ্য প্রশাসনের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এখন প্রশ্ন – সরকার কি সত্যিই দুর্নীতি বিরোধী অবস্থান নিতে প্রস্তুত, নাকি আগের মতোই তদন্তের নামে চোখে ধুলো দিয়ে মূল সমস্যা আড়াল করে রাখবে? বিডিও ময়ুখ দত্ত মজুমদারের ইস্তফা প্রমাণ করেছে সৎ মানুষের জায়গা এই সিস্টেমে দিনকে দিন সংকুচিত হচ্ছে। কিন্তু তার সঙ্গেই এই ঘটনাটি আরও এক সত্য সামনে আনছে- দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কখনও সম্পূর্ণ দমিয়ে রাখা যায় না। বিডিও ময়ুখ দত্ত মজুমদারের এই ইস্তফা উত্তর জেলায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে নতুন বিতর্কের আগুন জ্বালিয়েছে- এবার সেই আগুন নেভাবে কে? সরকার নাকি আবারও সবকিছু ধুলোর নিচে চাপা পড়ে যাবে?