সংসদীয় সংস্কৃতি

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

যে কোনও দেশের সংসদের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম দিক হচ্ছে সেই দেশের সংসদের প্রতিনিধিরা। অর্থাৎ সাংসদরা আইনকক্ষে কী ভূমিকা নেন, তাদের আলোচনায় মান, বিষয়বস্তুর উপর তাদের পর্যালোচনা, রাজনৈতিক শিষ্টাচার – এগুলোর নিরিখেই একটি দেশের আইনকক্ষে সাংসদদের উৎকর্ষতা নির্ণয় করা হয়। একটা সময় ছিল, যখন ভারতের সংসদীয় বিতর্কের মান ছিল বিশ্বমানের। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামীদামি সংসদের মধ্যে হাতের আঙুলে গোনা যে অল্প কয়েকটি দেশ রয়েছে, যার আলোচনার মান ও বিতর্কের বিষয়বস্তু যে কোনও উল্লেখযোগ্য গবেষণাধর্মী বিষয়কে স্পর্শ করতে পারে, ভারতের সংসদের আলোচনার মান ছিল সেরকম গুটি কয়েক দেশের সংসদের মধ্যে অন্যতম। ভারতের সংসদে একসময় ঝানু বাগ্মী হিসাবে অনেকেই বিশ্বের সম্ভ্রম কুড়িয়েছেন। তাদের মধ্যে মধু লিমায়ে অটলবিহারী বাজপেয়ী, হীরেন মুখার্জি, জর্জ ফার্নান্ডেজ, সি এন আন্নাদুরাই, ড. বি আর আম্বেদকর, ফিরোজ গান্ধী কিংবা জওহরলাল নেহরুর মতো বাগ্মী সাংসদরা ভারতের পার্লামেন্টের উভয়কক্ষ অলংকৃত করতেন। কিন্তু সেই দিনগুলো আজ অতীত। সেই উৎকর্ষতা, বিশ্বমানের আলোচনা, সমৃদ্ধ বিতর্ক এখন ইতিহাসের পাতায়। বরং ‘গুরুগম্ভীর গুণগত উৎকর্যতার স্থানে আজ জায়গা করে নিয়েছে সাংসদ সদস্যদের মধ্যে ব্যক্তিগত আক্রমণ, সাংসদদের মুষ্টি আস্ফালন, একে অপর সতীর্থের দিকে ধেয়ে আসা, কুরুচিকর অঙ্গভঙ্গি এমনকি অশালীন শব্দ প্রয়োগ বাদ যাচ্ছে না কিছুই। তাই এখন সংসদের অধিবেশনে আলোচনা মানেই হই হট্টগোল, সভা ভণ্ডুল করে দেওয়া, আলোচনার নামে শোরগোল। এককথায় ভারতের সংসদীয় পদ্ধতি এখন প্রায় রসাতলে। শুধু সংসদ বলেই নয়, রাজ্যে রাজ্যে আইনসভাগুলোতেও মোটামুটি প্রায় একই চিত্র। এই অবস্থার কারণে এখন আইনকক্ষে আলোচনার সুযোগ ও সময় দুই-ই সংকুচিত হচ্ছে। রাজনৈতিক বিরোধ এখন এতটাই গ্রাস করেছে যে আইনকক্ষগুলোতে সদস্যদের মধ্যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গাটিতেও তা ছায়া ফেলছে। আগামী ২০ জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে সংসদের বাদল অধিবেশন। অধিবেশন চলবে ১১ আগষ্ট পর্যন্ত। অর্থাৎ সর্বসাকুল্যে মাত্র ১৭ দিন।বর্ষাকালীন এই সময়ে অন্য রাজ্যগুলোতেও বিধানসভার বাদল অধিবেশন শুরু হয়েছে অথবা চলতি মাসেই তা শুরু হবে। কিছু দেশের সংসদই হোক কিংবা রাজ্যে রাজ্যে বিধানসভার অধিবেশন,সর্বত্রই অধিবেশনগুলোর কার্যকালীন মেয়াদ তলানিতে ছুয়েছে। এ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলোর অভিযোগের বিরাম নেই। ফলে সর্বভারতীয় স্তরেই হোক কিংবা রাজ্যস্তরের অধিবেশনের হিসাব চিত্র মোটামুটি সর্বত্র একইরকম। অর্থাৎ সর্বত্রই চাঞ্চল্যকর ভাবে হ্রাস পাচ্ছে অধিবেশনের মেয়াদ। আরও তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, অভিযোগের ও পাল্টা অভিযোগের এই বিষয়টিও এখন মোটামুটি একপেশে হয়ে গেছে। বিরোধীরা অধিবেশনের মেয়াদ কমানোর প্রতিবাদে যতই আপত্তি তুলুক, সরকার পক্ষও আর আগের মতো বিরোধীদের কথা কানে তুলতে নারাজ। অর্থাৎ নিজের মতকে চাপিয়ে দেওয়ার একটা স্বচ্ছন্দতার এখন সরকারেরও একচেটিয়া অধিকার। এতে করেই উৎকর্ষতা হারাচ্ছে আইনসভার অধিবেশন। সংসদের পরিসরে আলোচনার সুযোগ কমে আসার এই অভিযোগটি নতুন কিছু বিষয় নয়। তবে বর্তমান কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরই বিরোধীদের এড়িয়ে চলা এব তাদের মতামত শুনতে না চাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এমনটাই অভিযোগ বিরোধীদের। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে প্রথম যে লোকসভার অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় সেই ৫ বছরে মোট ১৫ অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছিল অর্থাৎ বছরে তিনটি করে অধিবেশন হয়েছিল এবং ৫ বছরে মোট ৬৭৭ দিন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অথচ ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার গঠিত হওয়ার পর ষোড়শ লোকসভায় মোট ৫ বছরে ১৭টি অধিবেশন ডাকা হয়েছিল। মোট অধিবেশন বসেছে মাত্র ৩৩১ দিন। অর্থাৎ জওহরলা নেহরুর সময়কালে প্রথম ৫ বছরে লোকসভার অধিবেশন যতদিন অনুষ্ঠিত হয়েছে, মোদির ৫ বছরে লোকসভার অধিবেশন বসেছে ত চেয়েও অর্ধেক। শুধু তাই নয়, সংসদ এড়ানোর এই প্রবণতা বর্তমান সময়েও জারি রয়েছে। এ মুহূর্তে সপ্তদশ লোকসভার ৪ বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে হাে সময়কাল বড়জোর ৮ থেকে ৯ মাস। কিন্তু এই সময়ে অধিবেশ হয়েছে মাত্র ২৩০ দিন। নি:সন্দেহে এই প্রবণতা গণতন্ত্রের জন্য সুস্থতার লক্ষণ নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রায়শই তার সংসদীয় বক্তে ভারতকে ‘গণতন্ত্রের জননী’ আখ্যা দিয়ে থাকেন। অথচ গণতন্ত্রের মুল নির্যাস সংসদের অধিবেশনই যদি ছাঁটাই হতে হতে তলানিতে এসে দাঁড়ায়— এটা গণতন্ত্রের সংস্কৃতির পরিপন্থী। নিশ্চয়ই এর দায় বিরোধীদেরও রয়েছে। কিন্তু সরকারপক্ষ এই দায়ভার এড়াবে কী করে ?

Dainik Digital

Recent Posts

ইন্ডিগো ফ্লাইটে বোমার হুমকি!! কলকাতা বিমানবন্দর হাই অ্যালার্ট!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-মঙ্গলবার বিকেলে কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উচ্চ সতর্কতা জারি করা…

4 hours ago

আওয়ামী লীগের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করল নির্বাচন কমিশন!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-গেজেট নোটিফিকেশন দিয়ে আওয়ামী লীগের সবরকম কার্যকলাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করল বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী প্রশাসন…

5 hours ago

অবসর নিলেন দেশের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-সুপ্রিম কোর্টের ব্যাটন তুলে দিয়ে গেলেন বিচারপতি বি আর গাভাইয়ের হাতে। বুধবার ১৪…

6 hours ago

সিঁদুর’ প্রসঙ্গে বিজেপির ১০ দিনের ‘তিরঙ্গা যাত্রা’!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে প্রচারে নামতে চলেছে বিজেপি।পাকিস্তানকে জবাব দেওয়ায় ভারতীয় সেনা বাহিনীকে ধন্যবাদ…

7 hours ago

পুরনো ছন্দে ফিরছে উপত্যকা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে শ্রীনগর। শ্রীনগর বিমানবন্দরও মঙ্গলবার খোলার সম্ভাবনা রয়েছে। রাস্তা ঘাটে স্বাভাবিক…

7 hours ago

পঞ্জাবের বায়ুসেনাঘাঁটিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যে সামরিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, তা প্রশমনের পর মঙ্গলবার…

8 hours ago