রাহুল গান্ধীর ‘অনলাইন ভোট চুরি’র অভিযোগ যখন উঠল, নির্বাচন কমিশন ও বিজেপি তা উপহাস করে উড়িয়ে দিয়েছিল। ‘ভিত্তিহীন’, ‘ভ্রান্ত’- এই সব শব্দে লোকসভার বিরোধী দলনেতার দাবিকে খারিজ করা হয়। কিন্তু মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় নির্বাচন কমিশনের নতুন ‘ই-সাইন’ ফিচার এসে প্রমাণ করল, রাহুলের অভিযোগ, শুধু সত্যিই নয়, গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো গুরুতর।এই ঘটনা দু’টি সত্য উন্মোচন করেছে: এক, নির্বাচন কমিশনের দ্বিচারিতা; দুই, রাহুল গান্ধীর অভিযোগের অকাট্য সত্যতা।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাহুল গান্ধী দিল্লীর সাংবাদিক সম্মেলনে বিস্ফোরক অভিযোগ তুলেছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার বিজেপিকে ভোট চুরিতে সহায়তা করছেন। কংগ্রেসের ভোটারদের নাম অনলাইনে বেআইনিভাবে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। কর্ণাটকের আলন্দ বিধানসভায় ২০২৩-এর নির্বাচনের আগে ৬,০১৮ ভোটারের নাম বাদ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। কর্ণাটক রাজ্য পুলিশের সিআইডি তদন্তে উঠে এসেছে, ভুয়ো পরিচয়ে সিমকার্ড ব্যবহার করে, বিভিন্ন অ্যাপ ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে এই কারচুপি চলছিল। সে রাজ্যের সিআইডি তদন্ত করে জানিয়েছে, এর নেপথ্যে রয়েছে একটি বড় সিন্ডিকেট, যা কর্ণাটকের বাইরে থেকে পরিচালিত। রাহুলের অভিযোগ, সিআইডি প্রমাণ জোগাড় করতে কমিশনের কাছে গত আঠারো মাসে আঠারো বার তথ্য চেয়ে আবেদন জানানো সত্ত্বেও তারা কোনও জবাব দেয়নি। নির্বাচন কমিশন প্রথমে রাহুলের অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে অস্বীকার করলেও, ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে তাদের ECINet পোর্টালে ‘ই-সাইন’ ফিচার চালু করেছে। নতুন ব্যবস্থায় আবেদনকারীদের আধার-সংযুক্ত মোবাইল নম্বর দিয়ে পরিচয় যাচাই বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর অর্থ, এখন থেকে অনলাইনে ভোটার তালিকায় নাম যোগ, বাদ বা সংশোধনের জন্য আধার-সংযুক্ত মোবাইল নম্বরে পরিচয় যাচাই বাধ্যতামূলক। এই পরিবর্তন কার্যত স্বীকারোক্তি যে, পূর্ববর্তী ব্যবস্থায় গুরুতর গলদ ছিল। সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, তাহলে কমিশন এতদিন কী করছিল? কেন এই ব্যবস্থা আগে আনা হল না? ভোটার তালিকা ছিল অনেকটা মাছের বাজারের মতো; যে কেউ যে কোনও মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে অন্য রাজ্যের ভোটারের নাম বাদ দেওয়ার আবেদন করতে পারতেন। এখানে একটি বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনও ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। এতদিন ধরে নির্বাচনি আখ্যান নির্ধারণ করত শাসক দল, বিরোধীরা কেবল প্রতিক্রিয়ায় ব্যস্ত থাকত।এবার চিত্র বিপরীত, বিরোধী নেতা অভযোগ তুলছেন, শাসক দল এবং কমিশন বাধ্য হচ্ছে প্রতিক্রিয়া জানাতে। এই প্রবণতা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এক নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে। শুধু নির্বাচনি আখ্যানই বা কেন, রাজনীতির চলতি আখ্যানেও সূক্ষ্ম বদল পরিদৃশ্যমান। এতদিন ধর্ম, বিভাজনের অ্যাজেন্ডায় বিরোধীরা ফাঁদে পড়ত। কিন্তু রাহুল এখন শাসককে জবাবদিহির মুখোমুখি করছেন। তার অভিযোগে কেন্দ্রীয় শাসকদল পাল্টা সাংবাদিক সম্মেলন করতে বাধ্য হতে হয়েছে, গত দশ বছরে এমন ঘটনা ভারতে বিরল। তবে মূল প্রশ্নটি অপরিবর্তিত। সেটি হলো, নির্বাচন কমিশন কতটা স্বচ্ছভাবে কাজ করছে? ভোটার তালিকা গণতন্ত্রের ভিত্তি। এই তালিকার আরেক নাম ‘গণতন্ত্রের নামাবলি’। অতএব তার অখণ্ডতা ক্ষুণ্ণ হলে সমগ্র নির্বাচনি প্রক্রিয়ার উপর থেকে জনগণের আস্থা ভেঙে পড়ে। কমিশনের ভূমিকা সেই আস্থার রক্ষক হিসেবে নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হওয়া জরুরি। অথচ বাস্তবে, প্রথমে অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া এবং পরে নীরবে সংশোধনী আনা কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই দুর্বল করেছে। ই-সাইন ফিচার সমস্যার একটি আংশিক সমাধান হতে পারে, কিন্তু বৃহত্তর প্রেক্ষিতে প্রয়োজন গভীর আত্মসমালোচনা। কেন এত দিন ধরে প্রযুক্তিগত ফাঁকফোকর রয়ে গেল? কেন তদন্তকারী সংস্থাকে প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া হয়নি? গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে এই প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়া ছাড়ড়া গত্যন্তর নেই। ভারতের নির্বাচনি ব্যবস্থা বিশ্বের সবচেয়ে বড়,গণতন্ত্রের গর্ব! সেই ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে সামান্য সন্দেহও অগ্রহণযোগ্য। এখনজরুরি দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের; শুধু নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তন নয়, বরং অতীতের ত্রুটি ও ব্যর্থতার নিরপক্ষে ব্যাখ্যা দেওয়া। অন্যথায় যে ধারণা তৈরি হচ্ছে – আইন ও নিয়ম কেবল শাসকের স্বার্থেই প্রণীত ও প্রযোজ্য হয়; তা আরও দৃঢ় হবে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনাই আজ সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য, কারণ সাধারণ ভোটারের অধিকার এভাবে উপেক্ষিত হতে পারে না। রাহুলের তির সঠিক লক্ষ্যে আঘাত করেছে।এবার জনগণের পালা; গণতন্ত্র রক্ষায় এগিয়ে আসার।