দেশের শিক্ষিত যুব সমাজের মধ্যে বেকারত্বের কালো ছায়া ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। শিক্ষার আলো আজ অনেকের ঘরে পৌঁছেছে, কিন্তু সেই আলোর শেষপ্রান্তে যে কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি ছিল- তা যেন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা আজ যেন এক মরুভূমিতে পথহারা। তাদের হাতে ডিগ্রি আছে, কিন্তু নেই চাকরির নিশ্চয়তা, পরিশ্রম আছে, কিন্তু সুযোগ নেই। এই ভয়াবহ বাস্তবতার এক জ্বলন্ত উদাহরণ উঠে এসেছে মধ্যপ্রদেশ থেকে।
বিজেপি শাসিত রাজ্যের স্টাফ সিলেকশন বোর্ডের সাম্প্রতিক তথ্য গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। মাত্র ৭৫০০টি কনস্টেবল পদের জন্য আবেদন জমা পড়েছে প্রায় ৯ লক্ষ ৭৬ হাজার! অর্থাৎ একটি পদের জন্য লড়ছেন গড়ে ১৩ হাজার প্রার্থী। এদের মধ্যে রয়েছেন পিএইচডি গবেষক, ইঞ্জিনীয়ার, এমবিএ ডিগ্রিধারী, এমনকী বহু বেকার শিক্ষিত যুবক যারা একসময় নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন বড় প্রতিষ্ঠানে বা গবেষণার ক্ষেত্রে। অথচ আজ তারা লাইন দিচ্ছেন একটি পুলিশের কনস্টেবল পদের আশায় – একটি চাকরি নয়, যেন জীবিকার ন্যূনতম নিশ্চয়তার আশায়।
খাকি রঙ এক সময় ছিল গর্বের প্রতীক- দেশের সুরক্ষা ও সেবার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু আজ মধ্যপ্রদেশে সেটাই হয়ে উঠেছে অস্তিত্বের সংগ্রামের প্রতীক। যখন একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী ব্যক্তি কনস্টেবল পদের জন্য আবেদন করেন, তখন সেটি কেবল ব্যক্তিগত ব্যর্থতার গল্প নয়, বরং এটি পুরো ব্যবস্থার ভাঙনের গল্প।
এই পরিসংখ্যান কেবল মধ্যপ্রদেশের নয়, বরং গোটা ভারতের যুব সমাজের দুঃস্বপ্ন। সরকারী চাকরিতে পদ শূন্য, নিয়োগ প্রক্রিয়া ধীর, বেসরকারী খাতেও মন্দা। শিল্পক্ষেত্রে নতুন বিনিয়োগ কমেছে, স্টার্টআপ জগৎ ধুঁকছে, আর কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলত, উচ্চশিক্ষা যেন আর আশীর্বাদ নয় – বরং এক ভারী বোঝা।
শিক্ষিত বেকারত্ব এখন আর শুধু অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি সামাজিক সংকটেও পরিণত হয়েছে। বহু রাজ্যে বেকার যুবকদের আত্মহত্যা, অপরাধপ্রবণতা, মাদকাশক্তি, মানসিক অবসাদের খবর ক্রমেই বাড়ছে। একদিকে শিক্ষিত জনসংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে কর্মসংস্থানের হার বিপরীতমুখী – এই বৈপরীত্যই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।
দেশের তথাকথিত ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’- যে যুব সমাজকে আমরা দেশের শক্তি বলে জানি- তাদের এক বড় অংশ আজ পরিণত হচ্ছে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিসঅ্যাস্টার’-এ। যখন এক প্রজন্মের সম্ভাবনা নষ্ট হয়, তখন শুধু তাদের ভবিষ্যৎই হারায় না,দেশের
দেশের অর্থনৈতিক গতি ও সামাজিক স্থিতিও বিপন্ন হয়।
এই পরিস্থিতিতে সরকার ও নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। শিক্ষার পরিকাঠামো, কারিগরি দক্ষতা, শিল্পোন্নয়ন – সব ক্ষেত্রেই সমন্বিত পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি। শুধু ডিগ্রি নয়, চাই দক্ষতা। শুধু কোচিং সেন্টার নয়, চাই কর্মমুখী শিক্ষা। শুধু নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি নয়, চাই কার্যকর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন।
এখন সময় এসেছে মুখোশ খুলে সত্যিটা স্বীকার করার – শিক্ষা মানেই চাকরি নয়, কিন্তু শিক্ষা যদি কর্মের পথ না দেখায়, তবে তা সমাজের ব্যর্থতা।
যুব সমাজকে হতাশা থেকে টেনে তুলতে হলে সরকারকে শুধু সরকারী চাকরি নয়, বরং বেসরকারী শিল্প, প্রযুক্তি, কৃষি ও উদ্যোক্তা তৈরির সুযোগ তৈরি করতে হবে। না হলে, একদিন হয়তো আমরা দেখব – খাকি পোশাকের জন্য নয়, বরং এক মুঠো জীবিকার আশায় গোটা প্রজন্ম নামছে অস্তিত্বের রণক্ষেত্রে।