ভয়, নোট, ভোট

বিবিধ দক্ষযজ্ঞের পর সম্পন্ন হলো বিহারের নির্বাচন।কিন্তু যে ছবি প্রস্ফুটিত হলো তা শুধু এক রাজ্যের নয়, বরং এই দেশের গণতন্ত্রের আয়নায় এক অশোভন প্রতিফলন।এ লড়াই কেবল তেজস্বী যাদব বনাম নীতীশ কুমারের কিংবা বিজেপি, এমনকী প্রশান্ত কিশোরের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না। এই রণক্ষেত্রে আসল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল প্রাণহীন কিন্তু অতীব ক্ষমতাশালী ‘তৃতীয়’ পক্ষ, যার পোশাকি নাম অর্থ। আরও বিশদে বললে, ত্রিশ হাজার কোটি টাকার আর্থিক প্রলোভন।
এই ৩০,০০০ কোটি ছিল বিহারের নির্বাচনে সোনার চাবি- বেকার, মহিলা, প্রবীণদের অ্যাকাউন্টে ঢুকিয়ে দেওয়া এক ঢালাও দান। নির্বাচন নামক রাজসূয় যজ্ঞে এটাকেই বলা হচ্ছে ‘উন্নয়ন’। এই অর্থস্রোতের পেছনে শুধু ভোটার কেনার মনস্তত্ত্বই নেই, আছে এক নতুন ভোট-অর্থনীতি; যেখানে প্রতিশ্রুতি, প্রকল্প আর প্রতারণা একাকার। একদিকে সরকারী খরচে ‘খয়রাতির অর্থনীতি’, অন্যদিকে বিরোধী শিবিরের পাল্টা প্রতিশ্রুতির বন্যা। এখন দেখার, বিহারের জনতা কি একপক্ষের থেকে নগদ অর্থ নিয়ে, অন্য পক্ষের থেকে আরও বেশি পাওয়ার প্রত্যাশায় ভোট দিলেন? সমধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, বিহার সরকার কি শুধু জনতার মধ্যে টাকা-পয়সা বিতরণের কাজেই নিমগ্ন থাকবে? সম্ভবত এটাই এখন ভারতের নতুন গণতান্ত্রিক মডেল।
ক্ষমতার প্রভুরা জানেন টাকা দিলেই মানুষ চুপ করে না। তাই প্রচারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেছে নিয়েছিলেন পুরনো, পরীক্ষিত অস্ত্র- ‘ঘুষপৈঠ’। উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, শিক্ষা; সব চাপা পড়ে গেছে এই এক শব্দে। বিজেপির প্রচারে এখন শত্রু আর প্রতিবেশীর পার্থক্য মুছে গেছে। কে ‘অনুপ্রবেশকারী’, কে নাগরিক; এই বিভাজনই হয়ে উঠেছিল প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু। অথচ একাধিক সমীক্ষা জানিয়েছে, বিহারের বেকারত্ব, দারিদ্র্য, পরিকাঠামো সংকটের সঙ্গে এই ‘ঘুষপৈঠ’-এর সম্পর্কই নেই। বিহারে এসআইআরে ঠিক কতজন অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়েছে, উত্তর এখনও অজানা। আদপে এমন এক পরিমণ্ডল রচনার প্রচেষ্টা, যার কেন্দ্রে একটাই শব্দ; ‘ভয়’। ২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রের ক্ষমতায় বিজেপি, ২০০৫ থেকে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। অতএব সঙ্গত প্রশ্ন, এত অনুপ্রবেশকারীর আগমন ঘটল কীভাবে?
তাহলে এমন রাজনৈতিক হুমকির উদ্দেশ্য কী? শুধু মুসলমানদের মনে ভীতির সঞ্চার, এটা ভাবলে অতি সরলীকরণ হবে। মুসলমানদের সিংহভাগ এমনিতেও বিজেপির ভোটার নন। বিজেপিও তাদের ভোট প্রত্যাশা করে বলে অভিযোগ নেই। এই ভীতি সঞ্চারের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে, হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে বোঝানো যে কারা দেশকে ‘মুসলমান-মুক্ত’ করতে চাইছে, আর কারা সেই মুসলমানদের ‘তোষণ করছে’, সেটা স্পষ্ট করে দেওয়া। কিন্তু সমস্যা হলো, আসামের এনআরসি-ই হোক বা বিহারের এসআইআর, সব ক্ষেত্রেই যে মুসলমানদের চেয়েও গরিব হিন্দুরা বেকায়দায় পড়ছেন বেশি। পশ্চিমবঙ্গেও তথাকথিত নিম্নবর্ণের বহু মানুষ এসআইআরের নথি দেখাতে ব্যর্থ হবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর ঘোষণার পর যতজন আতঙ্কে আত্মঘাতী হয়েছেন, তাদেরও বেশিরভাগ হিন্দু। তৃণমূল কংগ্রেস ঠিক এই ভীতিরই সুযোগ নিচ্ছে। আসলে কারও রক্ষাকর্তা হিসাবে স্বীকৃতি পেতে গেলে প্রথমে তাকে বিপন্ন করে তোলাটা জরুরি! হিন্দুরা বিপন্ন, এই ভয়টা মনের মধ্যে গেঁথে দিতে না পারলে তারা হিন্দুদের রক্ষাকর্তা হয়ে উঠবে কীভাবে? পক্ষান্তরে মুসলমান বিপন্ন, এই ভয়টা সংখ্যালঘুদের মধ্যে প্রোথিত করে দিতে না পারলে বঙ্গের শাসকবর্গ কীভাবে তাদের রক্ষাকর্তা হয়ে উঠবে? সে কারণেই ভয়টাকে কেউ ভাঙতে চান না।

Dainik Digital: