ব্যতিক্রমী সম্পর্কের খোঁজ!!

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

ছয় বৎসর পর পর ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘাতে ছয় জড়াইয়াছে। একটি যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধ তৎপরতায় ময়দানে দুইটি দেশকেই দেখা গেলেও উহার পশ্চাতে অনেক কুশীলব দেশ ও শক্তি থাকিয়া যায়।মার্কিন রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপে ভারত পাকিস্তান এই সময়ে স্থায়ী সংঘর্ষ বিরতিতে রহিয়াছে।২২ এপ্রিলে পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার পর হইতেই এক যুদ্ধের আবহ তৈরি হইয়াছে দুই দেশের মধ্যে।দুই দেশের সামরিক বাহিনীর তৎপরতা তুঙ্গে উঠিলে দেশের জনগণ যখন ভাবিতেছিলেন এই যুদ্ধ কতদিন চলিবে, দীর্ঘকালীন নাকি স্বল্প কয়েকদিনের হইবে- সেই সকল গোনাগুন্তির মধ্যেই আসিয়া পড়িল স্থায়ী যুদ্ধ বিরতির পর্যায়।ভারত পশ্চিমি দেশগুলির অস্ত্র সরবরাহে সামরিক শক্তিতে পুষ্ট এই কথা সকলেই জানিত। অপর পক্ষে পাকিস্তানের সম্বল চিনা সহযোগিতা।
যদিও সংঘর্ষ বিরতি চলিতেছে তথাপিও এই পর্যালোচনা জরুরি কারণ এই ধরনের বিরতি না ভারত না পাকিস্তান কোনও দেশের নাগরিক ভাবিয়া উঠিতে পারেন নাই।সামরিকভাবে এশিয়ার এই অংশ এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ।তিন প্রতিবেশী দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী- চিন, ভারত এবং পাকিস্তান।ইহাদের মধ্যে অস্ত্র সরবরাহের প্রবাহ বদলাইয়া গিয়াছে।ভারত ঐতিহ্যগতভাবে নিরপেক্ষ দেশ ছিল। বর্তমানে স্পষ্টভাবেই আমেরিকার বলয়ে ঢুকিয়া আছে।এই দাবি লইয়া ১০ মে-র আগে যাহারা তর্ক জুড়িতেন তাহারাও এখন একমত হইবেন। আমেরিকা, ফ্রান্স হইতে বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনিয়া থাকে ভারত। পশ্চিমি দেশগুলির নিকট হইতে অস্ত্র ক্রয়ের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলাইয়া কমাইয়া দিয়াছে রাশিয়া হইতে সস্তা অস্ত্র ক্রয়। এই রাশিয়া শীতল যুদ্ধের সময় হইতে ভারতের মিত্র ছিল।
গত ছয় বৎসরে এই অঞ্চলে দেশগুলির কূটনৈতিক মেরুকরণে বড় ভূমিকা লইয়াছিল আফগানিস্তান। আফগানিস্তান যুদ্ধের পর আমেরিকার নিকট পাকিস্তানের প্রাসঙ্গিকতা আগের মতো নাই। পাকিস্তান তাই আর যুক্তরাষ্ট্র হইতে অস্ত্র কিনিতেছে না। পাকিস্তান ঝুঁকিয়াছে চিনের দিকে। চিনই অধিকাংশ অস্ত্র বেচিয়াছে পাকিস্তানকে। আবার পাকিস্তান আফগানিস্তানের সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়াছে। ব্যাস্তানুপাতিক চিন আফগানিস্তানকে বাদ দিয়া কোনও কিছু ভাবিতে পারিতেছে না। এই সকল সম্পর্ক বদলের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দুই পুরাতন প্রতিবেশী শত্রুর দুশমনি এক নতুন মোড় লইয়াছে। আমেরিকা একদিকে চিনকে মোকাবিলায় ভারতকে আশকারা, প্ররোচনা দিয়া থাকে। অন্যদিকে চিন নিজের বিনিয়োগ ও পৃষ্ঠপোষকতা বাড়াইয়া চলিয়াছে পাকিস্তানের জন্য।
একই সময়ে সীমান্ত লইয়া চিন আর ভারতের সম্পর্ক দিনে দিনে খারাপ হইতেছে। মাঝেমধ্যেই দুই দেশের সেনারা ধাক্কাধাক্কিতে জড়াইলেও ভারত সরকার প্রকাশ্য কথা বলিতেছে কম। ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্ক যুদ্ধ শুরু করিবার পর দুই পরাশক্তি চিন আর আমেরিকার মধ্যে সম্পর্ক স্মরণকালের মধ্যে খারাপ অবস্থার মধ্যে গিয়া ঠেকিয়াছে। সব মিলাইয়া এই অঞ্চলে শত্রু আর মিত্রের হিসাব একেবারে পাল্টাইয়া গিয়াছে। ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে এখন আমেরিকাই যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার তাহা ভারতবাসী জানিয়াছিলেন বটে, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভারতের মানুষ কোনদিনই অভিভাবক বলিয়া ভাবে নাই। অন্যদিকে পাকিস্তানের জন্য একই ভূমিকা লইবে চিন এমনই ভাবা গিয়াছিল কিন্তু হইলো অন্যকিছু। ভারত পাকিস্তান যখন সমরাঙ্গনের নিকটবর্তী চিন তখন পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াইবার কথা বলিয়াছে বটে কিন্তু সেইখানেও অভিভাবক হইয়া দাঁড়াইলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
আমেরিকাও জোরালোভাবে ভারতের পাশে দাঁড়াইয়াছে, যা সাম্প্রতিক অতীতে দেখা যায় নাই। কাশ্মীরে ২২ এপ্রিলের জঙ্গি হামলার পরপর প্রধানমন্ত্রী মোদি কথা বলিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে। ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স তখন সপরিবারে ভারতেই অবস্থান করিতেছিলেন। তখন ট্রাম্প প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্ব ভারতের প্রতি শক্তিশালী সমর্থন জানায়। অনেক ভারতীয় কর্মকর্তার নিকট এই সমর্থন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ লওয়ার সবুজ সংকেত বলিয়াই মনে হইয়াছে। যদিও প্রকাশ্যে আমেরিকা ভারতকে সংযম দেখাইতে বলিয়াছিল। পহেলগাঁওয়ের ঘটনার পর আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক দৃশ্যপটে যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন চোখে পড়িয়াছিল তাহা হইল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাৎক্ষণিকভাবে মোদির সঙ্গে কথা বলেন নাই। অথচ ওই সময় বিশ্বের এক ডজনের বেশি নেতার সঙ্গে মোদি যোগাযোগ করিয়াছেন। রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী ভারতীয় বিদেশমন্ত্রীর সহিত কথা বলিয়াছিলেন হামলার এক সপ্তাহ পর। মোদি ও পুতিনের মধ্যে ফোনে আলাপ হয় আরও পরে। এই সময় চিন সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান লয়। এই নতুন জোটকাঠামোর প্রভাব ভবিষ্যতের সামরিক সংঘাতে পড়িবে বলিয়া ধারণা করিতেছে আন্তর্জাতিক মহল।
ছায়াযুদ্ধের সময়ে ভারতের ঘনিষ্ঠতা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে।তখন ভারতের দুই-তৃতীয়াংশ সামরিক অস্ত্রই আসিত মস্কো হইতে।অন্যদিকে, পাকিস্তান তখন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েতের পরাজয়ে ফ্রন্টলাইন ভূমিকা লইয়াছিল। ১৯৮০-এর দশকে সেই ঘনিষ্ঠতার সুযোগে পাকিস্তান বহুল প্রতীক্ষিত এফ-১৬ জঙ্গি বিমান সংগ্রহ করিয়া লয়, যাহা ভারতের আকাশ দখলের সক্ষমতা খানিকটা খাটো করিয়া দেয়। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে উভয় দেশ পরমাণু পরীক্ষা করায় আমেরিকা তাহাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পাকিস্তান তখন এফ-১৬ বিমান কিনিবার চেষ্টা করিয়াও পায় নাই। পরিস্থিতি আরও পাল্টায় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় সন্ত্রাসী হামলার পর।
পাকিস্তান আবার যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রন্টলাইন সঙ্গী হইয়া উঠে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে। যদিও পাকিস্তান তালিবানের নেতাদের আশ্রয় দিয়া আমেরিকাকে বিভ্রান্ত করিয়াছিল, তবুও যুক্তরাষ্ট্র তাহাদের সামরিক খাতে কয়েক দশক ধরিয়া ডলার ঢালিতে থাকে।সে সময় পাকিস্তানের সব চাইতে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী ছিল আমেরিকা আর দ্বিতীয় শক্তি চিন।সময়ের পরিবর্তনে আমেরিকার নিকট পাকিস্তানের গুরুত্ব কমিতে থাকিলে চিন পূর্ণ সমর্থন দেয়। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী ২০০০-এর
দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পাকিস্তানের ৩৮ শতাংশ অস্ত্র চিন হইতে আসিত।গত চার বছরে এই হার বাড়িয়া দাঁড়াইয়াছে প্রায় ৮০ শতাংশে।এই সময়ে ভারত রাশিয়ার উপর নির্ভরতা কমাইয়া দেয়। ২০০৬ হইতে ২০১০-এর মধ্যে ভারতের ৮০ শতাংশ অস্ত্র আসিয়াছে রাশিয়া হইতে। আর গত চার বৎসরে এই হার কমিয়া দাঁড়াইয়াছে ৩৮ শতাংশে। বর্তমানে ভারতের অধিকাংশ অস্ত্র আমদানি হয় আমেরিকা, ফ্রান্স ও ইজরায়েলের মতো মিত্রদেশ হইতে। যদিও এই দফায় সংঘর্ষ বিরতির আগে ও পরের দিন অবধি পাকবাহিনীর সব ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন নিষ্ক্রিয় করার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা লইয়াছিল রাশিয়ার এস-৪০০ যাহা সুদর্শন নামে সেনাবাহিনীর হাতে তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে।
পাকিস্তানের সহিত একটি ব্যতিক্রমী সম্পর্ক এখনও রহিয়া গিয়াছে, তাহা হইলো এফ-১৬ বিমান কর্মসূচি। পাকিস্তান গত দুই দশকে এফ-১৬ বিমান বহর সম্প্রসারণ করিয়াছে। সর্বশেষ বাইডেন প্রশাসন ৪০০ মিলিয়ন ডলারের সার্ভিস ও রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি অনুমোদন করিয়াছে।উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের সংঘর্ষে পাকিস্তান একটি রুশ তৈরি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করিয়াছিল।এই ক্ষেত্রে তাহারা এফ-১৬ ব্যবহার করে। ভারতের তরফে এই লইয়া আপত্তি জানাইলে আমেরিকা স্পষ্টীকরণে বলিয়াছিল, ঘটনা তাহাদের অজ্ঞাতেই হইয়াছে। যদিও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ রোধে পাকিস্তানকে দেওয়া এফ-১৬ আসলে ভারতের বিরুদ্ধেই যে ব্যবহার করিবে পাকিস্তান তাহা ওয়াশিংটনের অজানা ছিল না।এইবার সংঘর্ষ বিরতির পর আলোচনা শুরু হইবে।সেই আলোচনাতেই ফের স্পষ্ট হইবে সম্পর্কের ব্যতিক্রম।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

পদ্মশ্রী প্রাপ্ত কৃষি বিজ্ঞান সুবান্না আয়াপ্পানের রহস্যমৃত্যু,!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত কৃষি বিজ্ঞানী ৬৯ বছর বয়সি সুবান্না আয়াপ্পান ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ…

3 hours ago

রেশনে ডালের দাম বাড়ল পাঁচ টাকা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-রাজ্যের রেশনশপে একলাফে মশুরি ডালের মূল্য প্রতিকিলোতে ৫ টাকা বৃদ্ধি করেছে রাজ্য সরকার।রেশনশপে…

4 hours ago

টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে নিলেন কোহলি!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে নিলো বিরাট কোহলি।ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অনুরোধ রাখলো না।রোহিত…

4 hours ago

সমাজিকমাধ্যমে বিদেশসচিব মিস্রীকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ নেটিজেনরা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-সাম্প্রতিক ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বিদেশসচিব বিক্রম মিস্ত্রি। রবিবার সকাল থেকে…

4 hours ago

প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ফের উচ্চস্তরীয় বৈঠক!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-রবিবার সকালে উচ্চস্তরীয় বৈঠক করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৷ এদিন তাঁর লোক কল্যাণ…

1 day ago

দেবালয় রক্ষা পায় না!!

আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের ৩৩ম বৃহত্তম দেশ পাকিস্তান।কিন্তু ঋণের জালে জর্জরিত পাকিস্তান দেশটির আর্থিক অবস্থা…

1 day ago