প্রবণতা স্পষ্ট।।

পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই এক স্পষ্ট প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।শ্রীলঙ্কায়, বাংলাদেশে, আর এখন নেপালে-তরুণ প্রজন্মই ব্যর্থ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে। যে সামাজিক মাধ্যমকে এক সময় তুচ্ছ বলে উড়িয়ে দেওয়া হতো সেটাই হয়ে উঠেছে সংগঠন, দুর্নীতি ফাঁস আর বিদ্রোহের হাতিয়ার। সরকারগুলো যখন একে বন্ধ করতে চেয়েছে, তখন তারা আবিষ্কার করেছে – দমননীতি কেবল বিদ্রোহকেই উসকে দেয়। এই অঞ্চলের পুরোনো অভিজাত শ্রেণীকে এখন সতর্ক হতে হবে। তারা চাইলেই এই জোয়ার থামাতে পারবে না। নতুন প্রজন্ম ক্ষমতার দরজায় কড়া নাড়ছে আর তারা চুপচাপ ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা রাখে না। ২০২৫ সালে নেপালের সরকার পতনের সঙ্গে বাংলাদেশে ২০২৪ সালে আর শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের পতনের বিস্ময়কর মিল এই অঞ্চলের শাসকদের ভাবাচ্ছে। ভাবাচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
নেপালে কে পি শর্মা ওলি পদত্যাগ করার পর সেখানে সেনাপ্রধান কার্যত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। পুরো ঘটনাই যেন ঢাকার ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বিশেষ করে পাঁচটি ক্ষেত্রে এই দুই দেশের ঘটনায় আশ্চর্য রকমের মিল পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো নেপালেও আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে জেন-জি। কাঠমাণ্ডু থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ একদিনে ছড়িয়ে পড়ে পোখারা, বিরাটনগর, ভরতপুর সহ ৭৭ জেলার রাজধানীতে। নেপালের ৩ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ জেন- জি আর ৯০ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী। তাই আন্দোলন মুহূর্তেই ব্যাপক হয়ে ওঠে। স্কুল-কলেজের পোশাক পরা হাজারো শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমেছিল। যুবসমাজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্লোগান তুলেছিল, যেটি সংগঠিত করেছিল এনজিও ‘হামি নেপাল’। এর নেতৃত্বে ছিলেন ৩৬ বছর বয়সী কর্মী সুদান গুরুং। এই তরুণেরা নেপো বেবি আর নেপো কিডস-এর বিরুদ্ধে সরাসরি ক্ষোভপ্রকাশ করছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় অভিজাত পরিবারের সন্তানদের চাকচিক্যময় বিলাসবহুল জীবনযাত্রা নিয়ে সমালোচনা ছড়িয়ে পড়েছিল।
বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারী চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কারণ কোটা আওয়ামী লীগের অনুগতদের জন্য বিশেষ সুবিধা তৈরি করছিল। প্রথমে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিলেও পরে আন্দোলনে মৌলবাদী গোষ্ঠী ঢুকে পড়ে। দুই দেশেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল তরুণদের মূল হাতিয়ার। বাংলাদেশে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ, আর নেপালে টিকটক (যেটি নিষিদ্ধ হয়নি)ও ভিপিএন আন্দোলন জমাতে ভূমিকা রেখেছিল। নেপালে ৪ সেপ্টেম্বর তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী পৃথ্বী সুবা গুরুং ২৬টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধের ঘোষণা দেন। কারণ হিসাবে বলা হয়, স্থানীয়ভাবে নিবন্ধন না করা, ঘৃণা ছড়ানো ঠেকানো, প্রতারণা রোধ ইত্যাদি। কিন্তু জনগণের চোখে এটা ছিল মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা। টিকটক আগে থেকেই নিবন্ধন করায় নিষিদ্ধ হয়নি।আর সেটিই আন্দোলনকারীদের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশে দীর্ঘ আন্দোলনের পর শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। আর নেপালে মাত্র দুদিনেই ওলি সরকারের পতন হয়েছে। বাংলাদেশে কোটা আন্দোলনে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হাজার মানুষ মারা যায়। সরকারী হিসাবে এক হাজারজন পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান মুহাম্মদ ইউনুস জানান, প্রায় এক হাজার পাঁচশ জন নিহত হয়েছিলেন। নেপালে প্রথম দিনের সংঘর্ষেই কুড়িজন নিহত হন। তাদের বেশির ভাগই তরুণ শিক্ষার্থী। বাংলাদেশে যেমন বিক্ষোভকারীদের হত্যার পর আন্দোলন তীব্র হয়েছিল, নেপালেও প্রথমদিনের মৃত্যুগুলো দ্বিতীয়দিনের বিক্ষোভকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। বাংলাদেশে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে বলেন। সেনাবাহিনী জানায়, তারা জনগণের পাশে থাকবে, গুলী চালাবে না। পাঁচ আগষ্ট হাসিনাকে হেলিকপ্টারে করে দেশ ছাড়তে হয়। নেপালেও একই ঘটনা। সেনাপ্রধান অশোক রাজ সিগদেল ওলিকে বলেন, সেনাবাহিনী স্থিতিশীলতা আনতে পারবে, যদি তিনি পদত্যাগ করেন। ফলে মঙ্গলবার ওলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থা আর নেপালের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিষিদ্ধকরণ- দুটিই তরুণদের ক্ষোভ উসকে দিয়েছে। দুই দেশেই আলোপন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা, পরে সাধারণ জনগণ তাতে যোগ দেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো,এ দুটি দেশ ভারতের প্রতিবেশী ও কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে এই দুই সরকারের পতন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন নির্দেশ করছে। নেপালে শুধু ২০২৫ সালেই একের পর এক চাঞ্চল্যকর কেলেঙ্কারি সামনে এসেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদ বিষয়ক মন্ত্রী ঘুষের অভিযোগে পদত্যাগ করেছেন। এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হয়েছেন। বিমানবন্দর নির্মাণে জালিয়াতি, নেপাল টেলিকমে অর্থ আত্মসাৎ, অভিবাসন দপ্তরে চাঁদাবাজি- এসব কেলেঙ্কারিতে রীতিমতো তোলপাড় হয়েছে। স্বর্ণ চোরাচালান ও শরণার্থী প্রতারণা কেলেঙ্কারিতেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষনেতারা জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু সাধারণ মানুষ দেখেছে, বড় নেতাদের আসলে কোনো সাজা হয় না। সেখানে দেখা যায়, তদন্ত দীর্ঘায়িত হয়, নিচুতলার কর্মীরা শাস্তি পান, অথচ ক্ষমতাবানরা বেঁচে যান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাজনীতিকদের সন্তানদের বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের পোশাক গয়না প্রদর্শনের ছবি ভাইরাল হয়েছে। তাদের ব্যঙ্গ করে বলা হচ্ছে নেপো কিডস। একটি তীব্র তুলনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে- তাদের সন্তানরা গুচির ব্যাগ নিয়ে ফেরে, আমাদের সন্তানরা কফিনে ফেরে। সাধারণ পরিবারের সন্তানরা অসুরক্ষিত প্রবাসী শ্রমের শিকার হয়ে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে কফিনে লাশ হয়ে ফেরে।
তাই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বন্ধ হওয়া কেবল মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার ঘটনা নয়, এটি জনগণের চোখে ছিল দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাত শ্রেণীর অপরাধ ঢাকার নতুন কৌশল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমই ছিল সেই মঞ্চ, যেখানে তরুণেরা নেতাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল ট্রায়াল চালাতেন। মিম, ভিডিও ও ভাইরাল ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে দুর্নীতি ফাঁস করতেন। এই প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করার পদক্ষেপ ছিল যেন সেই নৈতিক জবাবদিহিকে শ্বাসরোধ করে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ডিজিটাল ট্রায়াল অনেক সময় পক্ষপাত আর ভুয়া তথ্য ছড়ায়। আর রাগ ক্ষোভ যে বাস্তব সংস্কারে রূপ নেবে তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু যা স্পষ্ট তা হলো – একটা পুরো প্রজন্ম তার নেতা পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছে না। তারা নিজেরাই পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

Dainik Digital: