অনেকদিন পর ভারতের বিদেশনীতি একটি বলিষ্ঠ অবস্থান নিতে পেরেছে। ভারত বরাবরই তার নিজস্বতা এবং তার সার্বভৌম কূটনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য বিশ্ব দরবারে সমাদৃত হয়ে আসছে। আজ ভারত বিশ্বের দাদা রাষ্ট্র আমেরিকার মাসুল দেওয়ালকে অস্বীকার করে যে অবস্থান নিয়েছেন তা তার বরাবরের ছায়াকেই সামনে এনেছে। আমেরিকার দাদাগিরির সামনে ভারত কোনদিনই মাথা নোয়ায়নি। আজও সেই ভূমিকাই নিল। যে মুহূর্তে ভারতের প্রতি আমেরিকার শুল্কনীতি শাস্তিমূলক হিসেবে স্পষ্ট প্রতিভাত হচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে দিল্লীতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানোটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মোদির বার্তা পরিষ্কার। ভারত একটি সার্বভৌম শক্তি এবং ‘পশ্চিম বনাম বাকি বিশ্বের’ দ্বন্দ্বে নয়াদিল্লী কোন পক্ষ বেছে নেবে তা তার নিজস্ব স্বাধীনতা। ভারতকে বাধ্য করা যাবে না। মোদির বার্তা হলো, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারত তার নিজস্ব পথেই চলবে।
আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত স্বার্থে ভারতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বড় শক্তি আর নেই। কারণ, ভারতের জনসংখ্যা বিশাল, ভৌগোলিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ এবং ভারত পারমাণবিক ক্ষমতাসহ সামরিক শক্তির দিক থেকে চিনকে টেক্কা দেওয়ার মতো সক্ষমতা রাখে। চিন এশিয়ায় আধিপত্য চায় এবং ভবিষ্যতে আমেরিকাকে বিশ্বের অন্যতম শক্তি-এই পরিচয় থেকে সরিয়ে দিতে চায়। চিনের এই উচ্চাভিলাষ ভারতই ঠেকিয়ে দিতে পারে। জর্জ ডব্লিউ বুশের সময় থেকেই মার্কিন নীতি নির্ধারকেরা বুঝে গিয়েছিলেন, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শক্তির ভারসাম্য ধরে রাখতে হলে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার অংশীদারি অত্যন্ত জরুরি। এটা শুধু কথার কথা ছিল না। গত দশকে আমেরিকা- ভারত নিরাপত্তা সম্পর্ক দ্রুত গভীর হয়েছে। বিশেষত সামরিক সমন্বয়, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় এবং প্রযুক্তি সহযোগিতার ক্ষেত্রে এই দুই দেশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
এই অগ্রগতির একটি অংশ ছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের সময়। তখন তিনি চিনের ওপর চাপ বাড়ান এবং পাকিস্তানের নিরাপত্তা সহায়তা কমিয়ে দেন। এতে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। ভারত তখন তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। এর ফলে আজও স্পষ্ট- ভারত এখন আমেরিকার সঙ্গে অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি যৌথ সামরিক মহড়া করে। আবার আমেরিকাই এখন ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। দেখা গেছে আমেরিকা নিজ স্বার্থে বহুবার ভারতের স্বার্থ উপেক্ষা করেছে।কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার হামলা শুরু করলে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে তারা ভারতের কাছ থেকে পূর্ণ আনুগত্য আশা করেছিল।কিন্তু ভারত ইসরায়েল ও তুরস্কের মতো অন্যান্য মার্কিন মিত্ররা যা করেছে অর্থাৎ ওয়াশিংটনের চাপ মানেনি, বরং রাশিয়ার সস্তা তেলের আমদানি আগের তুলনায় বাড়িয়ে দেয় নয়াদিল্লী।
দুটি দেশের মধ্যে ক্রমান্বয়ে অগ্রগতি সত্বেও যুক্তরাষ্ট্র এমন অনেক কাজ করছে, যা সন্দিগ্ধ করেছে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলভাবে বের হয়ে যাওয়ার ঘটনাটি বাইডেনের সময়ে ঘটলেও মূল চুক্তি ট্রাম্প করেছিলেন। এটি মার্কিন নেতৃত্বের বিচক্ষনতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে। কারণ, এই পদক্ষেপ কার্যত আফগানিস্তান আবার তালেবানের দখলে ফিরে যায়। ২০২২ সালে উদ্বেগ আরও বাড়ে। কারণ, বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানকে আইএমএফ থেকে ঋণ পেতে সাহায্য করে।পাকিস্তানের তৈরি এফ ১৬ যুদ্ধবিমানগুলোর আধুনিকীকরণের জন্য ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের এক চুক্তি অনুমোদন করে। এতে শীতল যুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে আমেরিকার অস্ত্র দেওয়ার তিক্ত স্মৃতি আবার ভারতের সামনে চলে আসে। ট্রাম্পও পাকিস্তানের প্রতি এই সমর্থন আরও বাড়িয়েছেন। এর একটি বড় কারণ ছিল ব্যক্তিগত লাভ, যা কিনা ২০২৪ সালের এপ্রিলে স্বাক্ষরিত ক্রিপ্টোকারেন্সি চুক্তিতে স্পষ্ট হয়েছে। ভারত মনে করে ইউক্রেন যুদ্ধ অনেক দূরের সংঘাত।এই সংঘাতের কারণে ভারত নিজের স্বার্থ ঝুঁকিতে ফেলতে চায়নি। বিশেষ করে ভারত যখন দেখেছে, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের চাপের সুযোগ নিয়ে চিন রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় জ্বালানি কিনেছে, তখন ভারত রুশ জ্বালানি কেনা থেকে বিরত থাকতে পারেনি। ভারত আগেও এমন পরিস্থিতি দেখেছে। ২০১৯ সালে ট্রাম্প যখন ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা ফের আরোপ করেন, তখন ভারত তার সবচেয়ে সস্তা এবং নির্ভরযোগ্য জ্বালানি উৎসগুলোর একটি হারায়। আর সেই সুযোগ চিন ইরানের তেল অত্যন্ত কম দামে কিনতে শুরু করে এবং সেখানে নিজেদের নিরাপত্তা উপস্থিতি বাড়ায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরও একই ধারা দেখা যায়। এবার নয়াদিল্লী পুরানো ভুলের পুনরাবৃত্তি করলো না। চিন রাশিয়া থেকে স্থলপথে জ্বালানি আমদানির পথ শক্তিশালী করেছে। ফলে চিন এখন জানে, তাইওয়ান নিয়ে তারা যাই করুক, রাশিয়ার জ্বালানি পেতে কোনো সমস্যা হবে না। এই প্রবণতা নিঃসন্দেহে ভারতের কৌশলগত স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। তবে এবার ভারতও সস্তা রাশিয়ান তেলের সুবিধা নিতে পেরেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের এই সিদ্ধান্তকে সহজভাবে নেয়নি। তারা ভারতের রপ্তানি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক বসায়। ফলে মোট শুল্ক দাঁড়ায় ৫০ শতাংশ। পাশাপাশি তারা ভারতের বিরুদ্ধে গৌন নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেয়। তারা দাবি করে ভারত নাকি ‘রাশিয়ার ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড’ ঠেকাতে আমেরিকার প্রচেষ্টায় বাধা দিচ্ছে। এখন ভারতের ওপর মার্কিন শুল্কহারে চিনের রপ্তানির ওপর আরোপিত শুল্ককেও ছাড়িয়ে গেছে। এটি কার্যত ভারতের বিরুদ্ধে আমেরিকার একধরনের অর্থনৈতিক যুদ্ধ। পুতিনের দিল্লী সফরে আমেরিকার জন্য একটি সতর্কবার্তা হওয়া উচিত। আমেরিকা চাপ সৃষ্টি করলে এবং নীতি বদলাতে থাকলে সম্পর্ক শুধু দুর্বলই হবে- এটা তাদের জানা দরকার। আমেরিকার মনে রাখা দরকার, চিনের আগ্রাসী উত্থান ঠেকানোর জন্য ভারতের সঙ্গে স্বার্থভিত্তিক ‘নমনীয় জোট’ তৈরি করা আমেরিকার কার্যকর কৌশলগুলির একটি। সেদিক থেকে বলা যায়, আমেরিকার ভারতকে যতটা দরকার, ভারতের জন্য আমেরিকাকে তার চেয়ে কম দরকার।