পতনের কারণ!!

ডলারের সাপেক্ষে টাকার পতন এখন এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে আর সাধারণ ওঠানামার অজুহাত চলে না। গত মে মাসে যেখানে এক ডলার কিনতে ৮৫ টাকার কম লাগত, ডিসেম্বরের শুরুতেই সেই ডলার ৯০ পার করেছে। ডলার যত চড়ছে, আমদানি তত মহার্ঘ হয়ে উঠছে। তেল ও গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের দাম বাড়ার দাপটে দেশের অভ্যন্তরে মূল্যবৃদ্ধির চাপ তৈরি হচ্ছে। আর দাম বাড়ার বোঝা, স্বভাবতই, সাধারণ মানুষের কাঁধেই চেপে বসছে।অনেকে তড়িঘড়ি দোষ ঠেলছেন ট্রাম্পের আগ্রাসী বাণিজ্যনীতির দিকে। সেটা অমূলকও নয়। ট্রাম্প একের পর এক ভারতীয় পণ্যের উপর শুল্ক চাপিয়েছেন, ফলে আমেরিকামুখী ভারতীয় রপ্তানি কমছে, আর আমেরিকাই ভারতের বৃহত্তম রপ্তানির বাজার (প্রায় কুড়ি শতাংশ)। ট্রাম্পের নীতির ফলে ভারতের মোট রপ্তানিও মার খাচ্ছে এবং ডলারের জোগানে টান পড়ছে। বিপরীতে আমদানি কমেনি, বরং বেড়েছে, ফলে আমদানির জন্য ডলারের চাহিদাও বেড়েছে। জোগানের থেকে চাহিদা বেশি হওয়ার কারণে টাকার নিরিখে ডলারের দাম বাড়ছে। রপ্তানি কমলে ডলারের জোগান কমবে, আর চাহিদা যখন কমছে না, তখন ডলার শক্তিশালী হবেই। তবে এখানে গল্পটা আরও জটিল। শেয়ার বাজারও টাকার পতনের আগুনে ঘি ঢালছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা টাকার দুর্বলতা দেখেই আঁচ করে নিচ্ছেন; এভাবে টাকা নীচে গড়াতে থাকলে ভারতীয় বাজারে মুনাফা তুলে ডলারে ফেরানোর সময় ন্যূনতম লাভটুকুও থাকবে না। তাই তারা আগেভাবেই শেয়ার বেচে টাকাকে ডলারে বদলাচ্ছেন। ফলে ডলারের চাহিদা আরও বেড়ে টাকার পতন ত্বরান্বিত হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগের এই রক্তক্ষরণ অবশ্য মূল সমস্যা নয়, প্রধান আঘাত রপ্তানি থেকে।
কেন্দ্র সরকারের নিজস্ব পরিসংখ্যানই তা দেখাচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এ বছরের অক্টোবর মাসে ভারতের রপ্তানি কমেছে প্রায় ১২ শতাংশ। সবচেয়ে বড় রপ্তানি-বাজার আটটির মধ্যে সাতটিতেই রপ্তানি কমেছে – চিনই একমাত্র ব্যতিক্রম, যেখানে রপ্তানি উল্টে বেড়েছে ৪২ শতাংশ। আর আমেরিকায় রপ্তানি কমেছে সবচেয়ে কম; মাত্র ৮.৫৮ শতাংশ। সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, বাংলাদেশ, সবখানে রপ্তানির পতন অনেক তীব্র। সুতরাং ভারতের রপ্তানি ঝিমিয়ে পড়ছে ঠিকই, কিন্তু ট্রাম্পের নীতিকে এর জন্য একমাত্র দায়ী করা এখনই সম্ভব নয়।
তাহলে রপ্তানি ধসের প্রকৃত কারণ কোথায়? উত্তর লুকিয়ে দেশের ভিতরেই। গত বাজেটে আয়কর কমেছে, কিছু দিন আগে একাধিক পণ্যের উপর জিএসটি কমেছে। ফলে ভোক্তারা বেশি খরচ করছেন। দেশের বাজারে চাহিদা বেড়েছে হঠাৎ উল্লম্ফনের মতো। কিন্তু উৎপাদন কি তত দ্রুত বাড়ে? বাড়ে না। ফলে ঘরোয়া বাজারে চাহিদা-জোগানের ফারাক তৈরি হয়েছে। সাধারণ নিয়মে এ অবস্থায় দাম বাড়ার কথা; কিন্তু দাম বাড়ছে না কেন? কারণ, উৎপাদকরা ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারের বাড়তি চাহিদা মেটাতে রপ্তানির অংশ কমিয়ে দিচ্ছেন। ভারতের রপ্তানি বরাবরই কিছুটা উদ্বৃত্ত-নির্ভর; দেশে যা থাকে না, সেটাই রপ্তানি হয়। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়লে রপ্তানি কমে; চিত্রটা আবারও সেই পুরানো।
তবু শুধু চিনের রপ্তানি বাড়া দিয়ে পুরো পতন ব্যাখ্যা করা যায় না। আরও একটি বাস্তবতা আছে; বিক্রেতারা দেশের বাজারকে বেশি চেনেন, বিদেশি বাজারকে অনিশ্চিত মনে করেন। তাই সংকটের সময় রপ্তানির কাঁচি পড়ে আগে ছোট বাজারগুলির উপর, বড় বাজার অর্থাৎ আমেরিকা শেষ অবলম্বন। তাই আমেরিকায় রপ্তানি কমেছে সবচেয়ে কম।
রইল ট্রাম্পের শুল্ক-প্রহরের প্রশ্ন। ভারতীয় পণ্যের উপরে আমেরিকা পর্যায়ক্রমে শুল্ক চাপিয়েছে ১০ শতাংশ, তারপর আরও ১৫ শতাংশ, এরপর রাশিয়া থেকে তেল কেনার ‘শাস্তি’ হিসেবে আরও ২৫ শতাংশ। মোট শুল্ক এখন দাঁড়িয়েছে ভয়ঙ্কর; ৫০ শতাংশ। তুলনায় চিনের জন্য শুল্ক ৩০ শতাংশ, জাপানের জন্য ১৫ শতাংশ। ফলে ভারতীয় পণ্য যে আমেরিকার বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আগস্টের শেষে যে শুল্ক কার্যকর হয়েছে, তার প্রভাব অক্টোবরেই পুরোপুরি ধরা পড়বে এটা ভাবা অবাস্তব। দাম বাড়তে বাজার কিছুটা সময় নেয়; তাত্ত্বিক অর্থনীতিও তাই বলে।
কিন্তু শুল্ক ৫০ শতাংশ থাকলে সামনে রপ্তানি যে বড় ধাক্কা খাবে, তা নিশ্চিত। আর সেই সম্ভাবনাই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগেভাগে পালাতে বাধ্য করছে। ফলে টাকার পতন সরাসরি না হলেও পরোক্ষে ট্রাম্পের নীতির ফাঁদেই আটকে পড়ছে ভারতীয় মুদ্রা। ডলার যে টাকার সামনে সেঞ্চুরি হাঁকাতে যাচ্ছে, সেটা বাজার বুঝে গেছে; সরকার বুঝুক না বুঝুক।

Dainik Digital: