নেতৃত্বের আসল পরীক্ষা তখন হয় না, যখন সবকিছু সুষ্ঠুভাবে চলছে বা চলতে থাকে। আরও স্পষ্ট করে বললে, যখন ভালোসময় চলতে থাকে, তখন নেতৃত্বের আসল পরীক্ষা হয় না। নেতৃত্বের আসল পরীক্ষা হয় সংকটের সময়। যখন কোনোও কিছুই ঠিকভাবে চলে না, এককথায় দুঃসময় চলতে থাকে, তখনই নেতৃত্বের আসল পরীক্ষা হয়। সংকটের সময় একজন নেতার আচরণ, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, এবং সেই সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে কার্যকর করার কৌশল এবং সর্বোপরি আচরণের ধরনই স্পষ্ট করে দেবে ওই নেতা বা নেত্রী কতটা ভালো নাকি খারাপ। এই নেতৃত্ব সমাজের যেকোনোও ক্ষেত্রে হতে পারে। সেটা কোনও প্রতিষ্ঠান হতে পারে। সেটা কোনো রাজনৈতিক দল হতে পারে। সেটা কোনো যুদ্ধের ময়দান হতে পারে। আবার সেটা কোনো দেশ বা রাজ্যের সরকারও হতে পারে। তবে এই সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে রাজনৈতিক দল ও একটি সরকারের “নেতৃত্বের সংকট” নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করবো। কেননা, এই সময়কালে আমাদের এই ছোট্ট রাজ্য ত্রিপুরায় বর্তমান শাসক দল এবং জোট সরকারের নেতৃত্ব নিয়ে সমাজের বিভিন্ন মহলে নানা গুঞ্জন, আলোচনা সমালোচনা শোনা যাচ্ছে।সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন এবং অভিযোগ উঠেছে যে, রাজ্যের বর্তমান শাসক দল এবং সরকার নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে।
এখন মূল প্রশ্ন হচ্ছে নেতৃত্বের সংকট কী?নেতৃত্বের সংকট বলতে সাধারণত একটি প্রতিষ্ঠানে বা সমাজে যোগ্য ও কার্যকর নেতার অভাবকে বোঝানো হয়। যেখানে নেতৃত্বের অভাব বা দুর্বল নেতৃত্বের কারণে প্রতিষ্ঠান বা সমাজের লক্ষ্য অর্জনে সমস্যা দেখা দেয়। এই সংকট বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে পারে।যেমন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ব্যর্থতা, দলীয় কর্মীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এক নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কার্যকর গুণাবলির অভাব, কঠিন পরিস্থিতিতে দ্রুত এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, নেতার প্রতি কর্মীদের আশ বা বিশ্বাসের অভাব, নেতার সততা-নৈতিকতা এবং ব্যক্তিগত চরিত্রে দুর্বলতা, ইত্যাদি। সাধারণত এই বিষয়গুলো যখন প্রকট হয়ে ওে তখনই যেকোনোও রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে আর একইসাথে ঘটতে থাকবে নানা ঘটনা।যেমন, দলের অনুশাসনে ভিত নড়বড়ে হয়ে যেতে থাকে। কর্মীদের মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলা এবং দলের প্রতি অনুগত্যের অভাব প্রকট হয়ে ওঠে। যে যার মতো, যে যার খুশি চলতে থাকে। যে যার খুশিমতো কথা বলতে থাকে।প্রত্যেকেই দলের অনুশাসনের তোয়াক্কা না করে নিজেরাই মাতবুর হয়ে ওঠে। আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে নিজেরাই আইন ও বিচারের দায়িত্ব হাতে তুলে নেয়। ক্ষমতার অপব্যবহার বাড়তে বাড়তে একটা সময় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
আর এইসব যখন চলতে থাকবে, তখন বুঝতে হবে ওই রাজনৈতিক দলের অন্দরে নেতৃত্বের সংকট তৈরি হয়েছে। দলীয় অনুশাসনের ভিত আলগা হয়ে গেছে। বর্তমান রাজ্যের শাসক দলে এমনই নেতৃত্বের সংকট তৈরি হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে গুঞ্জন উঠেছে। কেননা, সাম্প্রতিক কালে রাজ্যের শাসক দলের অন্দরে এমন সব কাণ্ডকীর্তি ঘটে চলেছে, দলের বিভিন্ন পদে থাকা নেতা নেত্রীদের এমন সব বিতর্কিত এবং বেফাঁস মন্তব্য প্রকাশ্যে আসছে, যা এই গুঞ্জনকে আরও বেশি করে উসকে দিয়েছে। সবথেকে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এই সব চলতে থাকলেও দলের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেই। এই কারণেই দলের নেতৃত্ব সংকটের বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। কী চলছে, কেন চলছে, এ নিয়ে বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। কেননা, রাজ্যবাসী সবকিছুই জানে। রাজ্যের রাজনৈতিক সচেতন মানুষ প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে এসব শুনছে, দেখছে। এই পরিস্থিতি শুধু দলের অন্দরেই নয়। একই পরিস্থিতি সরকারের অন্দরেও। সরকারের ঘাড়েও এখন আমলাতন্ত্র চেপে বসেছে বলে খবর। আমলারাজ এমনভাবে জাঁকিয়ে বসেছে যে, রাজ্য মন্ত্রিসভাও নাকি।
কার্যত অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।অভিযোগ, আমলাতান্ত্রিক বেড়াজালে রাজ্যের মন্ত্রীরাও এখন জনস্বার্থে, নিজেদের এলাকার উন্নয়নের স্বার্থে, নিজেদের প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কোনো কাজ করতে পারছেন না। মোদ্দা কথা, আমলাদের দিয়ে কোনো কাজ করাতে পারছেন না। ফলে এক চরম অস্বাভাবিক এবং অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে রাজ্যে। অভিযোগ, আমলারা নানা অজুহাত তুলে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস,বছরের পর বছর ধরে ফাইল আটকে রাখছেন। রাজ্যের মন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত পাত্তা পায়না আমলাদের কাছে। অনেকেই বলছেন, বিগত বামফ্রন্ট শাসনের শেষ সময়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, এর চাইতেও পরিস্থিতি এখন ভয়ানক। অথচ, পরিস্থিতি মোকাবিলা করা বা নিয়ন্ত্রণ করার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অভিযোগ, এখন সরকার ও প্রশাসন চলছে আমলাদের ইশারায়। আমলাদের ইচ্ছা ও মর্জিমতো। ফলে, সরকারের অন্দরেও শক্তিশালী নেতৃত্বের সংকট লক্ষ্য করা যাচ্ছে।এভাবে যদি চলতে থাকে,তাহলে
এ রাজ্যে বিরোধীদের খুব একটা বেশি পরিশ্রম করতে হবে না।শাসক দল এবং সরকার, নিজেরাই নিজেদের পতনের জন্য যথেষ্ট বলে মনে করছে রাজনৈতিক সচেতন মহল।