বংলাদেশে নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই আন্তর্জাতিক আগ্রহ বা বাড়ছে। একদিকে বিদেশি কূটনৈতিক তৎপরতা, অন্যদিকে বেসরকারী সংস্থাগুলির হঠাৎ সক্রিয়তা। বিশেষ করে আমেরিকার দুটি প্রভাবশালী এনজিও-ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিক ইনস্টিটিউট ও ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিট- আবারও ঢাকায় মাঠে নেমেছে ‘গণতন্ত্রের প্রসার’-এর নামে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে গণতন্ত্রের সহায়তা কোথায় শেষ হয়, আর রাজনৈতিক খবরদারি কোথা থেকে শুরু হয়? বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে আগে বিদেশি সংস্থগুলির সক্রিয় হওয়া কোনও নতুন ঘটনা নয়। তবে এবার এই তৎপরতা অনেক বেশি লক্ষ্যণীয় ও সংগঠিত। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে চলা এই দুই সংস্থা দাবি করছে, তারা ‘দক্ষতা উন্নয়ন’, ‘ভোটার সচেতনতা’ ও ‘নির্বাচনি সহায়তা’-র কাজ করছে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এমন কর্মকাণ্ডের আড়ালে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা বহুবার দেখা গেছে। ইউক্রেন, সার্বিয়া, ভেনেজুয়েলা কিংবা মায়ানমারে – এসব দেশেই একই ধরনের এনজিও কার্যক্রম পরবর্তীতে ভূরাজনৈতিক কৌশলের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গণতন্ত্র প্রসারের দাবি থাকলেও শেষ পর্যন্ত উদ্দেশ্য অনেক সময়ই ছিল সংশ্লিষ্ট দেশের রাজনৈতিক স্থিতি ও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করা।
বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। ২০০০-এর দশকে IRI ও NDI-র কাজ নিয়ন্ত্রণে আনতে বাধ্য হয়েছিল তৎকালীন সরকার। কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল- তারা ‘অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সরাসরি প্রভাব ফেলছে’, যা জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক। নতুন রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সংস্থাগুলি আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা তরুণ নেতৃত্ব তৈরির নামে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালাচ্ছে, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে অংশীদারী করছে, নির্বাচনি পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে, এমনকি মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ ও ভোট সমীক্ষা পরিচালনাও করছে।
এই কার্যকলাপগুলো উপর থেকে নিরীহ মনে হলেও বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এগুলির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। একটি মেরুকৃত ও উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে যেখানে ক্ষমতার পালাবদলই কেন্দ্রীয় ইস্যু, সেখানে বিদেশি এনজিওর উপস্থিতি অনেক সময় ‘সহযোগিতা’ নয়, বরং পর্যবেক্ষণ ও প্রভাব বিস্তারের কৌশল হয়ে দাঁড়ায়।
২০২৬ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা নির্ধারণের নয়, বরং একটি পরিণত রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরীক্ষার ক্ষেত্র।সেই প্রেক্ষাপটে নয়াদিল্লী সতর্ক করেছে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি – বিদেশি অর্থে পরিচালিত সংস্থাগুলিকে জানাতে হবে তাদের অর্থ কোথা থেকে আসছে, কোন্ সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে এবং তাদের প্রকল্পের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী। গণতন্ত্রের সহায়তা নামে অর্থের প্রবাহ যদি অস্বচ্ছ থাকে, তবে তা জনআস্থা নষ্ট করে। নির্বাচনি প্রক্রিয়া শক্তিশালী করার কাজ বিদেশি সহায়তার মাধ্যমে নয়, নিজেদের সামাজিক ও নাগরিক পরিসরে হওয়া উচিত। ভোটার শিক্ষা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ এবং গণতান্ত্রিক চেতনা গড়ে তোলার কাজ বাংলাদেশ নিজেই করতে পারে। গণতান্ত্রিক দেশগুলির সহযোগিতা মূল্যবান, তবে তা যেন পরস্পরের প্রতি সম্মান ও স্বাধীনতার ভিত্তিতে হয়। বাংলাদেশ অংশীদার হতে পারে, কিন্তু অভিভাবকত্ব গ্রহণ করা চলবে না। গণতন্ত্রে বিদেশি প্রভাবের জায়গা কখনওই নেই।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি অনেক সময় দাবি করে, তারা কেবল ‘সহায়ক’ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো যে দেশে নির্বাচন, সেখানে বিদেশি সংস্থা যত বেশি সক্রিয় হয়, ততো বেশি সন্দেহ তৈরি হয় তাদের অভিপ্রায়ের প্রতি।
গণতন্ত্রের মাপকাঠি কোনও বিদেশি এনজিও নয়, বরং দেশের জনগণ নিজেরাই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতি এবং আঞ্চলিক ভূকৌশলগত ভারসাম্যের জন্য এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল সময়।
একটি বিদেশি সংস্থার প্রশিক্ষণ বা কর্মশালা যতই নিরপেক্ষ দাবি করা হোক না কেন, তার পেছনের অর্থায়ন ও লক্ষ্য যদি রাজনৈতিক হয়, তবে সেটি গণতন্ত্রের বিকাশ নয় বরং প্রভাব বিস্তারের সূক্ষ্ম কৌশল।
গণতন্ত্র কোনও রপ্তানি দ্রব্য নয়। এটি বিকশিত হয় নিজের সমাজে, নিজের সংস্কৃতিতে, নিজের রাজনৈতিক চেতনায়।
বাংলাদেশকে তাই এখনই সতর্ক হতে হবে- যেন ‘গণতন্ত্রের সহায়তা’র নামে কোনও বিদেশি শক্তি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে না পারে। গণতন্ত্রের আলো নিজের হাতে রাখা সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। কারণ বাইরে থেকে আনা আলো হয়তো ঝলমলে, কিন্তু তার তাপ অন্য কারও স্বার্থেই জ্বলে।