গত মাসে দুই দশক অতিক্রান্ত হলো ভারতে তথ্যের অধিকার আইন।এই আইন, যা সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্রের গোপন পর্দার আড়ালে উঁকি দেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল।২০০৫ সালের ১২ অক্টোবর এই আইন চালু হয়েছিল এক ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি নিয়ে, নাগরিক জানবেন, সরকার জবাব দেবে। আজ, বিশ বছর পরে, সেই প্রতিশ্রুতির আলো ম্লান হয়ে এসেছে। রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা যেন আবারও গোপনীয়তার দেওয়ালের আড়ালে ঢেকে যাচ্ছে।
এই আইন আদপে সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ ততোখানি নয়, যতোখানি ছিল জনগণের লড়াইয়ের ফসল। রাজস্থানের প্রত্যন্ত গ্রামে গত শতকের আটের দশকে শ্রমিকেরা জানতে চেয়েছিলেন, সরকারের প্রকল্পে যে টাকা আসে, তা আদৌ তাদের মজুরি অবধি পৌঁছায় কি না। সেই জানার অধিকারকে আন্দোলনে রূপ দিয়েছিলেন সমাজকর্মী অরুণা রায় ও নিখিল দে। তাদের ‘মজদুর কিষান শক্তি সংগঠন’ মানুষকে শেখায় – তথ্য মানেই ক্ষমতা। এই স্লোগান থেকেই জন্ম নেয় এমন এক ভাবনা, যা ভারতের গণতন্ত্রকে নতুন রূপ দেয় এবং সেই দাবি থেকেই জন্ম নেয় প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা আনার অঙ্গীকার – তথ্যের অধিকার আইন। তাই এই আইন কেবল প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয় ছিল না, বরং ছিল এক গণ আন্দোলনের জয়। সেই সূত্রে ‘জবাবদিহি’ কথাটি প্রথমবার সরকারী অভিধানে স্থান পায়। পরীক্ষার খাতা দেখার অধিকার থেকে শুরু করে পঞ্চায়েতের উন্নয়ন প্রকল্পের হিসাব, সর্বত্র নাগরিকরা প্রশ্ন করতে শুরু করেন। অনেক দুর্নীতি, অনিয়ম এবং সরকারী প্রকল্পের অর্থলুপ্তি প্রকাশ্যে আসে। রাজনীতি ও প্রশাসনের জোটবদ্ধ গোপনীয়তা ভাঙে। গণতন্ত্রের ভিত যেন আরও শক্ত হয়।
কিন্তু সেই আলোসম্পাত বেশিদিন টেকেনি। দুই দশক পরে দেখা যাচ্ছে, তথ্য কমিশনগুলি ক্রমশ অকার্যকর হয়ে পড়ছে। অনেক রাজ্যে কমিশনারের পদ খালি, ফাইল জমে পাহাড়, নাগরিকের আবেদন মাসের পর মাস ঝুলন্ত। ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এই আইনে যে সংশোধনী আনে, তাতে কমিশনারদের কার্যকালের মেয়াদ, বেতন ও পদমর্যাদা হ্রাস করা হয়। সব মিলে এই আইন আজকের ভারতবর্ষে কার্যত প্রশাসনের অংশ, বস্তুত এক নখরবিহীন আইনে রূপান্তরিত হয়েছে। তথ্য কমিশনের পদে বসানো হয়েছে অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের, যাদের জীবনের সারাংশই গোপনীয়তার শপথে মোড়া। ফলে ‘জনগণের জানার অধিকার’-এর জায়গায় ফিরে এসেছে সরকারের সুবিধামতো তথ্য দেওয়ার সংস্কৃতি। উত্তর আসছে না সময়মতো, আর এলেও তা এমনভাবে কাটাছেঁড়া যে সত্যের অর্ধেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে। যে আইনের উদ্দেশ্য ছিল দুর্নীতি রোধ,তা আজ হয়ে উঠেছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার আরও এক ঘেরাটোপ।অতএব তথ্য কমিশন আজ নিস্তেজ, প্রশাসন ফের শক্তিশালী। সরকার এখন ‘ডিজিটাল পার্সোনাল ডেটা প্রোটেকশন’ আইন, সংশোধিত তথ্য প্রযুক্তি আইন এবং অন্য তথ্যপ্রযুক্তি বিধি, সব মিলিয়ে অসংখ্য সরকারী তথ্যকে ‘ব্যক্তিগত’ বলে চিহ্নিত করে দিয়েছে। ফলত, সেই তথ্য এখন আরটিআই-এর আওতার বাইরে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো, যারা এই আইনের জোরে দুর্নীতির মুখোশ খুলেছিলেন, তাদের একে একে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে। ‘কমনওয়েলথ হিউম্যান রাইটস ইনিশিয়েটিভ’-এর তথ্য মতে, শতাধিক আরটিআই কর্মী খুন হয়েছেন, আরও আড়াইশোর বেশি আক্রান্ত। সাম্প্রতিক উদাহরণ আমেদাবাদে এক দৃষ্টিহীন আরটিআই কর্মীর খুন, যিনি এক দশকেরও বেশি সময় বিবিধ দুর্নীতির পর্দাফাঁস করেছিলেন।
হুইসলব্লোয়ারদের সুরক্ষা দিতে যে আইন ২০১১ সালে প্রস্তাবিত হয়েছিল, ২০২৪ সালে পাস হলেও তা এখনও চালু হয়নি। এটি প্রমাণ করে, সরকার চায় না সত্যি প্রকাশ পাক। তথ্যের অধিকার আইন এই দেশের গণতন্ত্রকে এক সময় নতুন শক্তি দিয়েছিল। ‘জনগণই সর্বোচ্চ’ এই মন্ত্রে বিশ্বাস জুগিয়েছিল। কিন্তু আজ, কুড়ি বছর পর এই আইনের প্রাণভোমরা শুকিয়েছে। যদি এখনই তথ্য কমিশনগুলিকে স্বাধীন ও সক্রিয় করা না হয়, যদি হুইসলব্লোয়ার নিরাপত্তা আইন কার্যকর না হয়, তবে গণতন্ত্রের ভিত ক্রমে ফাঁপা হয়ে যাবে। তার চেয়েও উদ্বেগের বিষয়, তথ্য না দেওয়ার সংস্কৃতি ক্রমে রাজনৈতিক হয়ে উঠেছে। অথচ এই আইন কেবল প্রশাসনিক স্বচ্ছতার জন্য নয়, এটি ক্ষমতার ভারসাম্য ফেরানোর একটি গণতান্ত্রিক উপকরণও বটে। নাগরিককে জানতে দেওয়া মানে তাকে অংশীদার করা। সেই অধিকার যদি খর্ব হয়, গণতন্ত্র হয়ে পড়ে অর্ধাঙ্গ।সত্য যতই অস্বস্তিকর হোক, যে রাষ্ট্র নাগরিককে তথ্য দেয় না, সেই রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক নয়, কর্তৃত্ববাদী।