দ্বৈত মানদণ্ড!!

দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ভারত-পাকিস্তান এশিয়া কাপ ম্যাচ কেবল ক্রিকেটের মাঠেই সীমাবদ্ধ রইল না।দু ‘পহেলগাঁওয়ে নিহত পর্যটক ও দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে এটি হয়ে উঠল রাজনৈতিক ও নৈতিক দ্বন্দ্বের প্রতীক। এই ম্যাচ প্রমাণ করল যে যুদ্ধ, সন্ত্রাস এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড একসঙ্গে চলতে না পারলেও বাণিজ্য এবং ক্রিকেটের আনন্দ একবিন্দুতে মিলিত হতে পারে। এই ম্যাচ বোঝাল মানুষের আবেগ, পরিবারের ক্ষত এগুলি গৌণ। রাজনৈতিক প্রস্তাব, বয়কটের ডাক, নাগরিক ও প্রাক্তন খেলোয়াড়দের আপত্তি, সব কিছু উপেক্ষিত। কোটি কোটি টাকার লেনদেন, বিজ্ঞাপনের চড়া মূল্য, টিভি ভিউয়ারশিপ, এ-সবই মুখ্য।
মাত্র পাঁচ মাস আগের নৃশংসতম সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতীয় সমাজের বড় অংশ- প্রাক্তন রাজনীতিবিদ, প্রাক্তন খেলোয়াড় এবং নিহতদের পরিবার, পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন। তবুও আইসিসি, যেখানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পুত্র স্বয়ং শীর্ষকর্তার আসনে, তিনিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেন ভারতকে মাঠে নামাতে। স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক, টিকিট বিক্রি থেকে ১২.১৩ মিলিয়ন ডলার, টেলিভিশন সম্প্রচার ও বিজ্ঞাপন থেকে প্রায় ১৪০০ কোটি টাকার আয়, সব মিলে এই খেলার পিছনে বাণিজ্যিক লক্ষ্যই প্রকট হল। জাতীয় নিরাপত্তা এবং নাগরিক আবেগের বিপরীতে টাকার প্রলোভন এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হল। রাজনৈতিক আবেগের সঙ্গে টাকার লোভ এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম, আদতে দ্বৈত মানদণ্ডের পরিচায়ক।
পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিদের বুলেটে নিহত শুভম দ্বিবেদীর স্ত্রী আইশান্যা বিসিসিআইকে আবেদন করেছিলেন ম্যাচ বয়কট করতে। কিন্তু মানুষের আবেগকে উপেক্ষা করে ব্যবসায়িক ও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে ম্যাচ আয়োজন করা হল। দ্বৈত মানদণ্ড কেবল ক্রিকেটের ক্ষেত্রেই নয়, শিল্প ও বিনোদনের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। পাকিস্তানি শিল্পীদের ভারতে ভিসা, সিনেমা মুক্তি, টিভি সিরিজ- সহ সর্বক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বহুদেশীয় প্রতিযোগিতার দোহাই দিয়ে ক্রিকেট খেলার অপার বাণিজ্যের মোহে তার ব্যত্যয় ঘটানো যায়। এটাই দ্বৈত মানদণ্ড: এখানে কূটকৌশলের সূক্ষ্মতাও লক্ষণীয়। মাঠে সরাসরি বিরোধিতা না করে ভারতীয় বোর্ড ও সরকার আন্তর্জাতিক নিয়ম, টেলিভিশন রেটিং এবং বিজ্ঞাপনের টাকা-সব কিছুর মধ্যে ভারসাম্য স্থাপন করেছে। মানুষকে দেখানো হল, ভারত ‘নৈতিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীল’, কিন্তু বাস্তবে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক স্বার্থই কার্যকর। এই ম্যাচ রাষ্ট্রীয় কূটকৌশলের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকল, যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্ত, টিকিটের দাম থেকে শুরু করে প্রচারাভিযান, মিডিয়ার কভারেজ- একটি পরিকল্পিত নীতিগত ও অর্থনৈতিক চিত্রনাট্য মেনে অনুষ্ঠিত হল।
ম্যাচের ফলাফল, দর্শক সংখ্যা বা টেলিভিশন রেটিং, সবকিছুই ব্যবসার দিক থেকে সফল। কিন্তু মানুষের আবেগ, নিহত পরিবারগুলির ক্ষত, সামাজিক প্রভাব, সবকিছু অবহেলিত হল। দেশবাসী বুঝল যে যুদ্ধ, সন্ত্রাস এবং খেলা একসঙ্গে চলতে পারে না, কিন্তু বাণিজ্য এবং ক্রিকেটের আনন্দ মিলিত হতে পারে। মানুষের বিবেক ও জাতীয় আবেগকে ব্যবহার করে খেলার সঙ্গে কার্যত ব্যবসার জুয়া খেলানো হল। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক রাজনীতি ও দ্বৈত মানদণ্ড স্পষ্ট: একদিকে সন্ত্রাসের নিন্দা, পাকিস্তানের মুখোশ উন্মোচনের লক্ষ্যে অন্তত তেইশটি দেশে সর্বদল প্রতিনিধি পাঠানো, আবার অন্যদিকে টাকার লোভ। ক্রিকেট এখন কেবল ব্যাট-বল বা উইকেটের বিষয় নয়, এটি দেশের গণতান্ত্রিক অনুভূতি, মানুষের আবেগ ও জাতীয় স্নেহকে রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক কৌশলের খেলনা বানিয়ে দিয়েছে। পাঁচ মাস আগের হামলার স্মৃতি এখনও তাজা, তবুও ক্রিকেট মাঠে খেলা চলল; যেখানে নৈতিকতার প্রশ্ন, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ একত্রে পরিলক্ষিত হল।
এই দ্বৈত মানদণ্ড এবং কূটকৌশল আমাদের শেখায়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও অর্থনৈতিক স্বার্থ মানুষের আবেগকে কত সহজে ঢেকে দিতে পারে। জল আর রক্ত একসঙ্গে বইতে পারে না-কিন্তু ক্রিকেট এবং বাণিজ্য একসঙ্গে বইতে পারে। এক্ষণে প্রশ্ন, যে রাজনীতি সন্ত্রাসবাদী হামলার অজুহাত দিয়ে ম্যাচের বিরোধিতা করে, সেই রাজনীতিই আবার কীভাবে ম্যাচের পক্ষে দাঁড়ায়? এই রাজনীতির ফলে ক্রিকেটের কোনো ক্ষতি হয়নি। ক্ষতি হয়েছে জনগণের বিবেকের। মানুষকে তার সামনেই বোকা বানানো হয়েছে, অথচ সে বুঝতেও পারেনি। ‘অপারেশন সিঁদুর’ কি এখনও চলছে? যদি চলছে, তবে ম্যাচ কেন হচ্ছে? যাদের সঙ্গে যুদ্ধের পরিমণ্ডলে আছি, তাদের সঙ্গেই আবার ম্যাচ খেলেছি; এ কেমন দ্বিচারিতা? রবিবাসরীয় সন্ধ্যায় এমন বহু প্রশ্ন অগণিত দেশবাসীকে মর্মবিদ্ধ করেছে।

Dainik Digital: