ত্রিপুরা সহ উত্তর-পূর্বে বর্ষা ও বন্যার ভয়াবহতা: রোগবালাই ও প্রতিকার নিয়ে চিকিৎসকের জরুরি পরামর্শ!!

এই খবর শেয়ার করুন (Share this news)

দৈনিক সংবাদ প্রতিনিধি:-প্রাককথন: বর্ষা মানেই সজীব প্রকৃতি, কিন্তু…
বাংলার প্রকৃতিতে বর্ষা এসেছে তার রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে। কিন্তু এই সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে নানা বিপদ। বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় এবং মিজোরাম এখন প্রবল বর্ষণ ও তার ফলে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় বিধ্বস্ত। একদিকে ঘরবাড়ি ডুবে যাওয়া, অন্যদিকে জলবাহিত ও মশাবাহিত রোগের বাড়বাড়ন্ত – এই দুইয়ের চাপে সাধারণ মানুষ কার্যত অসহায়।
এই পরিস্থিতিতে জনসচেতনতা ও সঠিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি চেষ্টা করছি সাধারণ মানুষের কাছে সহজ ভাষায় তুলে ধরতে কী কী রোগ এই মৌসুমে বেশি হয়, কীভাবে বুঝবেন আপনি আক্রান্ত হয়েছেন কিনা এবং কীভাবে নিজেকে ও পরিবারকে নিরাপদে রাখবেন।
বর্ষার সঙ্গে আসা রোগগুলির তালিকা ও তা প্রতিরোধের উপায় ১.ডেঙ্গু:
কারণ: Aedes aegypti নামক মশা সকালবেলা কামড়ায় এবং স্বচ্ছ জমা জলে (যেমন ফুলদানি, কুলার, ফ্রিজের ট্রে, পাথরের গর্ত) বংশবিস্তার করে।
লক্ষণসমহ:-হঠাৎ উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর চোখের পেছনে ব্যথা পেশি ও গাঁটে ব্যথা ত্বকে র‍্যাশ বা লালচে ফুসকুড়ি বমি বমি ভাব বা বমি মারাত্মক ক্ষেত্রে প্লেটলেট কমে যাওয়া, রক্তপাত, শক
প্রতিরোধের উপায়:-জমা জল জমতে না দেওয়া মশারি ব্যবহার ফুল হাতা জামা ও প্যান্ট পরা মশার ধূপ বা লিকুইড ব্যবহার বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা।২. ম্যালেরিয়া:-কারণ: Anopheles মশা সন্ধ্যার পর কামড়ায়। মশার মাধ্যমে Plas-modium নামক পরজীবী রক্তে প্রবেশ করে।
লক্ষণসমূহ:-অনিয়মিত জ্বর, সাধারণত তীব্র ঠান্ডা ও কাঁপুনি দিয়ে শুরু মাথা ব্যথা, বমি ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়া দুর্বলতা জন্ডিস বা প্যালর
প্রতিরোধ:-রাতে মশারি ব্যবহার বাধ্যতামূলক ঘরে ও বাইরে মশা নিধন স্প্রে করা নালা-ড্রেন পরিষ্কার রাখা মশার প্রজননস্থল নির্মূল।৩. টাইফয়েড:-
কারণ: দূষিত জল ও খাদ্যের মাধ্যমে Salmonella typhi ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ ঘটায়।লক্ষণ:-দীর্ঘস্থায়ী মাঝারি থেকে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর মাথা ব্যথা পেটব্যথা, বমি ক্ষুধামান্দ্য
দুর্বলতা।প্রতিরোধ:-ফুটানো জল পান করা রাস্তার খাবার এড়িয়ে চলা হাত ধোয়ার অভ্যাস পরিচ্ছন্ন রান্না ও পরিবেশ।৪. লেপ্টোস্পাইরোসিস:-
কারণ: জল জমা জায়গায় হাঁটার
সময় বা খোলা ক্ষতের মাধ্যমে Leptospira ব্যাকটেরিয়া দেহে প্রবেশ করে।লক্ষণ:-জ্বর, চোখ লাল হয়ে যাওয়া গাঁটে ব্যথা, পেশি ব্যথা প্রস্রাবে জ্বালা, কিডনি বা লিভারের সমস্যা
মারাত্মক হলে মেনিনজাইটিস বা শক
প্রতিরোধ:-জল জমা রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটা থেকে বিরত থাকা বুট বা গামবুট ব্যবহার জল বন্ধ সংযোগে গ্লাভস ব্যবহার।৫. হেপাটাইটিস A ও E:-
কারণ: দূষিত জল বা খাবারের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ায়।লক্ষণ:-জ্বর, বমি চোখ ও ত্বকে হলদে রং (জন্ডিস) প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হয়ে যাওয়া ক্ষুধাহীনতা।প্রতিরোধ:-
ফুটন্ত জল পান:-পরিচ্ছন্ন টয়লেট ব্যবহার হাইজিন মেনে রান্না করা বর্ষায় স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু অভ্যাস ও টিপস।১. ফুটানো জল বা ফিল্টার করা জল খান। সম্ভব হলে একবার ফুটিয়ে ঠান্ডা করে খান। বা ফিল্টার থাকলে সেটি নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন।২.পাকা ফল কেটে রাখবেন না।দ্রুত খেয়ে ফেলুন এবং ঢেকে রাখুন।৩.ভিজে জামাকাপড়ে বেশিক্ষণ থাকবেন না। বর্ষাকালে শরীর ঠান্ডা লেগে গেলে ভাইরাল ইনফেকশন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।৪. সঠিক স্যানিটেশন বজায় রাখুন।, টয়লেট এবং রান্নাঘর সবসময় জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করুন। ৫. যেসব এলাকায় বন্যার জল জমে রয়েছে, সেখানে খালি পায়ে হাঁটবেন না। গামবুট ব্যবহার করুন।৬. ইমিউন সিস্টেম ভাল রাখতে প্রতিদিন মৌসুমি ফল ও ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ খাবার খান।৭. গর্ভবতী মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম।
বন্যা পরিস্থিতিতে জরুরি পদক্ষেপ:- ত্রিপুরার অনেক অংশ এখন নদী প্লাবনের কারণে জলমগ্ন। পরিস্থিতি সামাল দিতে স্থানীয় প্রশাসন, এনডিআরএফ ও স্বাস্থ্য বিভাগ সক্রিয় হলেও সাধারণ নাগরিকদের নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হতে হবে।
জরুরি কিছু করণীয়:-
বিদ্যুৎ চলাকালীন ভিজে জায়গা স্পর্শ করবেন না।শিশুর খেলনা, পাত্র, কাপড় ঠিকভাবে পরিষ্কার করুন।
বন্যার জল শরীরে লাগলে ঘরে এসে পরিষ্কার জল দিয়ে, স্নান করুন। জ্বর, বমি, পেট ব্যথা হলে অবহেলা না করে চিকিৎসকের কাছে যান।
চিকিৎসকের সতর্কবার্তা: কখন দেরি না করে হাসপাতালে যাবেন?
টানা ৩ দিনের বেশি জ্বর রক্তবমি বা রক্তপাত চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া বা প্রস্রাবের রং গাঢ়, অতিরিক্ত দুর্বলতা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, পাতলা পায়খানা ও বারবার বমি এই লক্ষণগুলি দেখা দিলে নিজে ওষুধ না খেয়ে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান।
উপসংহার: রোগ নয়, সচেতনতা আমাদের রক্ষা করতে পারে।
বর্ষা আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, কিন্তু তা যেন দুর্যোগ না হয়ে ওঠে তার দায়িত্ব আমাদেরই।
স্বাস্থ্যবিধি, পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা ও সময়মতো চিকিৎসা- এই তিনটি হল এই সময়ের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। আমরা যদি নিজেরা একটু সতর্ক থাকি, তাহলে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও আমরা সুস্থ ও নিরাপদ থাকতে পারি।

Dainik Digital

Share
Published by
Dainik Digital

Recent Posts

বায়ুসেনা পাচ্ছে ৩ অত্যাধুনিক নজরদারি বিমান ‘আইস্টার’!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-দেশের বায়ুসেনাকে আরও তেজী করে তুলতে এবং আকাশপথে শত্রুপক্ষের উপর সকল গতিবিধির নজরদারি…

9 hours ago

ভারত-মায়ানমার সীমান্তে ৩৬ ঘণ্টায় ছ’বার ভূমিকম্প,!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-ভারত-মায়ানমার সীমান্তে ৩৬ ঘণ্টায় ছ’বার ভূমিকম্প। ভূমিকম্পটির ঝাকুনি মৃদু হলেও বারংবারের ভূমিকম্পে ব্যাপক…

10 hours ago

প্রশান্ত মহাসাগরে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে সকল যাত্রী নিহত!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-রবিবার বিকাল ৩টায় ডারবানের ভার্জিনিয়া বিমানবন্দর থেকে ছেড়েছিল জেডএস-কেএফবি নিবন্ধিত পাইপার চেরোকি বিমানটি।…

16 hours ago

স্বপ্ন আরও উচ্চতায়!!

আরও এক ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে ভারত। আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে প্রথম ভারতীয় হিসাবে পা রাখতে চলেছেন নভশ্চর…

19 hours ago

গুগল ম্যপের নির্দেশনায় মাঝরাতে গাড়ি গিয়ে ঝুলল নির্মীয়মাণ উড়ালপুলে!!

অনলাইন প্রতিনিধি:-গুগল ম্যাপ দেখে গাড়ি চালাচ্ছিলেন পরিণতি হল গাড়ি উঠে গেল অর্ধনির্মিত উড়ালপুলের মুখে। শেষ…

19 hours ago

রোগে আক্রান্ত সুপারি বাগান,ক্ষতির মুখে চাষিরা!!

অনলাইন প্রতিনিধি :-উত্তর ত্রিপুরারজম্পুই পাহাড় ও কাঞ্চনপুর মহকুমার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সুপারি গাছে অজানা রোগের প্রাদুর্ভাব…

19 hours ago