দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানসবার্গে প্রথমবার আয়োজিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বের তিন শক্তিধর রাষ্ট্রের (আমেরিকা, রাশিয়া, চিন) রাষ্ট্র প্রধানদের অনুপস্থিতিতে গোটা বিশ্বকে ফের একবার বার্তা দিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণেই প্রধানমন্ত্রী মোদি বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দুতে বড় পরিবর্তনের দাবি করে, গোটা বিশ্বের সামনে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং জোরালো অবস্থান তুলে ধরলেন। একই সাথে সম্পদ-বঞ্চিত অঞ্চলের উন্নয়ন, ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানের সংরক্ষণ এবং বিশ্বব্যাপী দক্ষতা বৃদ্ধির আহ্বান জানান। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাদকচক্র এবং সন্ত্রাসের সম্মিলিত লড়াইয়ের বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলের মতে, আফ্রিকা মহাদেশে প্রথমবার জি-২০ সামিট আয়োজনের প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী মোদির বক্তব্য ছিল শুধু কূটনৈতিক নয়, বরং বহু দশকের বৈশ্বিক অসমতার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী বার্তা। মোদির কথায়, উন্নয়ন মানেই শুধু পরিকাঠামো নয় বা জিডিপি বৃদ্ধির অঙ্ক নয়, উন্নয়ন মানে এমন ব্যবস্থা যা সবার জন্য, প্রকৃতি- সমন্বিত ও সভ্যতার চিরন্তন জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মোদি বলেছেন, আফ্রিকার দীর্ঘস্থায়ী সম্পদ-বঞ্চনা, পরিবেশগত অসাম্য এবং বৈশ্বিক নীতি নির্ধারণে উপেক্ষিত অবস্থান আজ পৃথিবীর সামনে এক ঐতিহাসিক প্রশ্ন তুলেছে। উন্নয়নের মাপকাঠি কি নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার সময় আসেনি?
শীর্ষ সম্মেলনে ‘সবাইকে সঙ্গে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি’ শীর্ষক উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, ভারতের ইন্টিগ্রাল হিউম্যানিজম’ দর্শন এমন উন্নয়নের মডেল দেয় যা মানবতা, সমাজ, প্রকৃতি ও অর্থনীতিকে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে দেখে। তিনি একের পর এক তিনটি বড় আন্তর্জাতিক প্রস্তাব সামনে রাখেন, যা আগামী দশকে বৈশ্বিক সহযোগিতা নতুনভাবে সাজিয়ে দিতে পারে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল। প্রথম প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলির সমৃদ্ধ জ্ঞান সংরক্ষণ ও বিশ্বব্যাপী ভাগাভাগি করা দরকার। স্বাস্থ্য, পরিবেশ, কৃষি, সামাজিক ভারসাম্য নানা বিষয়ে জনগোষ্ঠীগুলির যে ঐতিহ্যগত জ্ঞান বয়েছে তা হারিয়ে যাচ্ছে আধুনিকতার চাপে। ভারতের ‘ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমস’ উদ্যোগকে ভিত্তি করে জি- ২০ এর সহযোগিতায় একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির আহ্বান জানান তিনি।তার কথায় ‘সময় বদলাচ্ছে, কিন্তু জ্ঞান হারালে ভবিষ্যতের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাবে।
আফ্রিকার উন্নয়নকে বৈশ্বিক অগ্রগতি পূর্বশর্ত হিসেবে তুলে ধরে মোদি তার দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলেন, আফ্রিকার তরুণ প্রজন্মই ভবিষ্যতের কর্ম বাজারে সবচেয়ে বড় শক্তি। তাই দক্ষতা বৃদ্ধিতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ অপরিহার্য।। এজন্য তিনি ‘ট্রেন-দ্য-ট্রেইনার’ ভিত্তিক এক উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের কথা বলেন, যা আগামী দশ বছরে আফ্রিকায় ১০ লক্ষ দক্ষ প্রশিক্ষক তৈরি এবং যারা আরও লক্ষ লক্ষ যুবককে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থান গড়ে তুলবেন। মোদি স্মরণ করিয়ে দেন, ভারতের সভাপতিত্বে আফ্রিকান ইউনিয়নকে স্থায়ী সদস্যপদ দেওয়া শুধু কুটনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং বৈশ্বিক উন্নয়ন স্থাপত্যে আফ্রিকার ন্যায্য স্থান নিশ্চিত করা। তৃতীয় প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর কন্ঠ আরও দৃঢ় শোনায়। বিশ্বজুড়ে ফেন্টানিলসহ শক্তিশালী সিন্থেটিক মাদকের বিস্তারকে শুধু স্বাস্থ্য সংকট নয়, বরং সন্ত্রাস ও অর্থ পাচারের বৈশ্বিক জাল হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি। এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ও মাদক নেটওয়ার্কের আর্থিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করবে। অবৈধ অর্থ প্রবাহ বন্ধে সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। গোয়েন্দা আইন ও নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও দৃঢ় করবে। মোদির ভাষায় ‘সন্ত্রাসবাদ ও মাদক একে অপরকে শক্তিশালী করে। এটি শুধু নিরাপত্তা নয়, সমাজ ও ভবিষ্যত প্রজন্মের প্রশ্ন।’
প্রধানমন্ত্রী মোদি আরও বলেছেন, জি- ২০ এর মঞ্চে আফ্রিকার উপস্থিতি কেবল কূটনৈতিক ঘটনা নয়। এটি পৃথিবীর গতিপথ পরিবর্তনের সুযোগ। জ্ঞান, দক্ষতা এবং নিরাপত্তা, এই তিন স্তম্ভে মোদির প্রস্তাব বৈশ্বিক নেতৃত্বের সামনে এক নতুন পথচিত্র এঁকে দেয়। আগামী আলোচনায় এই প্রস্তাবগুলি বৈশ্বিক সহযোগিতার নয়া অধ্যায়-নির্ধারণ করতে পারে, এমনটাই অনুমান আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলের। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানসবার্গে জি-২০ সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বৈশ্বিক উন্নয়ন পরিমাপের কাঠামোকে নতুন করে ভাবার আহ্বান জানিয়ে গোটা বিশ্বকে যে বার্তা দিয়েছেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল। অনেকের মতে, মোদির এই জোরালো বার্তাই উন্নয়নের কার্যকর বৈশ্বিক মডেল হয়ে উঠতে পারে আগামীদিনে।