বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলে বিহারবাসী ভোটারেরা নীতীশ কুমারের নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটকেই আবার ক্ষমতায় ফেরালেন।আগামী পাঁচ বছরের জন্য নীতীশ কুমারকেই হয়তো বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখবে দেশ। ২০০০ সালে প্রথম নীতীশকে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে দেখা গিয়েছিল, সমতা পার্টির হয়ে। এরপর নানান পটপরিবর্তনের ফাঁকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাতেও ছিলেন তিনি। ৭৫ বছর বয়সী নীতীশ কুমার বিহার রাজ্য জন্মের পর দীর্ঘ সময়ের মুখ্যমন্ত্রী। তার শাসনের তুলনা করা হয়ে থাকে মূলত তাঁর পূর্বেকার দোর্দন্ডপ্রতাপ মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদবের শাসনকালের সঙ্গেই। দেশে সব চেয়ে খারাপ শাসনব্যবস্থার রাজ্যগুলি, যাদের হাতে পর্যাপ্ত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি কাঙ্খিত অগ্রগতির মুখ দেখতে পায়নি সেই তালিকায় অন্যতম হলো বিহার।
লালু যাদবের শাসনের তুলনায় নীতীশের বিহার শাসন অনেকটাই আশা জাগিয়েছে সাধারণ বিহারবাসীকে। রাজনৈতিক পরিভাষায় দেশের শাসকদল বিজেপি এবং বিহারের লালু বিরোধীরা লালু যাদবের শাসনকালকে জঙ্গলরাজ বলে থাকেন। এই নির্বাচনের প্রচারেও দেশের প্রধানমন্ত্রী বারবার জঙ্গলের রাজত্বের কথা বলেছেন। ভোটের ফলাফলে এনডিএ জোটের বিশাল জয়কে নানান ভাবে ব্যাখ্যা করা শুরু হয়েছে। তবে এনডিএর ফলাফল যে এতটাই ভালো হবে তা কোনও নিষ্ক্রমণ সমীক্ষাতেও অনুমিত হয়নি। কথা উঠতে শুরু হয়েছে, এই ফলাফল কি বাস্তবের প্রতিচ্ছবি? বিহারে এসআইআরের বিরোধিতা নিয়ে কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী এবং তেজস্বী যাদবদের ‘ভোট চোর গোদ্দি ছোড়’ আন্দোলন শুরু হয়েছিল ভোট ঘোষণার আগে তাতে কিন্তু বিশাল মানুষের অংশগ্রহণ চোখে পড়েছে। জনবিস্ফোরণ দেখা গিয়েছিল ভোেট ঘোষণার পর বিরোধীদের সভা, কর্মসূচিগুলিতেও। কিন্তু সে সবের কোনও প্রতিচ্ছবি ভোটের ফলাফলে দেখা গেল না।
স্পষ্টতই, বিষয়টি নিয়ে অনেকদিন বিতর্ক, দোষারোপ চলবে। কংগ্রেসের মুখপাত্র গণনা শেষ হবার আগেই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমারকে লক্ষ্য করে তোপ দাগিয়েছেন। বিহারের ভোটের খেলায় জ্ঞানেশ কুমারকেই চ্যাম্পিয়ন বা ম্যান অফ দ্য ম্যাচ বলতে শুরু করেছেন। আগাম বলা যায়, এবার ফের কথা উঠবে বৈদ্যুতিন ভোটিং যন্ত্রের প্রোগ্রামিং নিয়ে। দেশে এই যন্ত্রের ব্যবহার শুরুর লগ্ন থেকেই পরাজিতরা, মানে বিরোধীরা প্রতিকূল ফলাফলের ক্ষেত্রে যন্ত্রটির ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।আজ যারা দিল্লীর মসনদে রয়েছেন তারাও কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের আমলে বিভিন্ন নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ হিসেবে ভোটিং যন্ত্রের প্রোগ্রামিং নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যত দিন যাচ্ছে এই যন্ত্রটির প্রতি মানুষের সন্দেহ বেড়ে চলেছে বিরোধীদের ক্রমাগত দোষারোপের ফলে। মানুষের কাছে যন্ত্রটির গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের সামনে চলে আসতে পারে শীঘ্রই। আজকাল ভোটিং যন্ত্রে কারসাজি এই দেশে বিরোধীদের প্রচারেরও অস্ত্র। নিউ ইয়র্কের মেয়র পদে মামদানির জয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে সেই দেশে বৈদ্যুতিন ভোটিং যন্ত্রের অনুপস্থিতির কথা বলে থাকেন ভারতের বিরোধী দলগুলি।
কিন্তু ভারতের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশে ভোটিং যন্ত্র বাতিল করে ফের ব্যালটে ফিরে যাওয়া কতটা সহজ হতে পারে সেই কথা বলবে ভাবীকাল। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের বিশাল জনসংখ্যা তার অর্থনৈতিক শক্তি। বিশাল জনসংখ্যা মানে বিশাল ঘরোয়া বাজার যা পৃথিবীর প্রথম অর্থনীতির দেশগুলির জন্যও ঈর্ষার। দেশের এই বিশালতা এই দেশের গণতন্ত্রের গর্ব কারণ দেশে ভোটার সংখ্যাও বিশাল। তাদের অংশগ্রহণ ও মতদানে গঠিত হয় নতুন সরকার। ভোট ঘোষণা হলে শাসক চায় প্রত্যাবর্তন আর বিরোধীরা পরিবর্তনের ডাক দিয়ে থকেন। দুই পক্ষের লড়াইয়ে আন্দোলিত হয় জনচিত্ত। তারা বেছে নেন তাদের পছন্দের প্রার্থী বা দল। এই লড়াইয়ে লাভ যা হয় তা হয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার। বিহার এই নির্বাচনে সেই প্রমাণ দিয়েছে। রাজ্যটির জন্মের পর যত নির্বাচন হয়েছে ভোটের হার সর্বোচ্চ ছিল এই বছরে। ফলাফলে যে দলই জিতুক বা হারুক, দলগত কারো লাভ কারো ক্ষতি হলেও পুরোটাই লাভ হয়েছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার। এই অবস্থান থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, শাসক দলের স্টার সব প্রচারক থেকে শুরু করে বিরোধী দলের রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, তেজস্বী যাদবদের মতো মারকুটে নবীন রাজনীতিক সবাইকেই কৃতজ্ঞতা জানাবে ভারতের গণতান্ত্রিক ভাবনায় ভাবিত জনচিত্ত। তাই জেগে থাকুক ‘জঙ্গলরাজ’, পথেই থাকুক ‘ভোট চোর গদ্দি ছোড়’।