ক্ষমতার কূট-নীতি!!

১১ সেপ্টেম্বর। দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ঘটনার কারণে মানবসভ্যতার ইতিহাসে দিনটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রথম ঘটনাটি বিশ্ব মানবতার বন্দনার জন্য, দ্বিতীয়টি বিশ্বের ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস সন্ত্রাসবাদী নাশকতার জন্য। এবার এগারো সেপ্টেম্বর শিকাগোতে স্বামী বিবেকানন্দের সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতার ১৩২ বছর পূর্তি হল, পাশাপাশি পূর্ণ হল নিউ ইয়র্কের গগনচুম্বী জোড়া সৌধের ধ্বংসের সেই দুঃখদীপ্ত দিনের চব্বিশ বছর। গত এগারো তারিখ আরও একটি কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ভারতের হিন্দুত্ববাদী বাস্তুতন্ত্রে। এদিন জীবনের পঁচাত্তর বছর পূর্ণ করলেন সরসংঘচালক মোহন ভাগবত। এর পাশাপাশি, গত এগারো বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বে এই প্রথম নরেন্দ্র মোদি সংঘপ্রধান ভাগবতের কার্যত স্তুতি বন্দনা হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত একাধিক সংবাদপত্রে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখলেন। তবে এ নিবন্ধ কেবল শ্রদ্ধার্ঘ্য নয়, বরং নাগপুর ও বিজেপি, উভয়ের উদ্দেশে হিসাবি রাজনৈতিক বার্তা, অধিকন্তু ক্ষমতার কূটনীতি বলেই মনে হয়েছে।
প্রবন্ধে দিনটির গুরুত্ব বোঝাতে মোদি প্রথমেই টেনে আনেন ১৮৯৩ সালে শিকাগো ধর্মমহাসভায় স্বামী বিবেকানন্দের ঐতিহাসিক বক্তৃতা, পরে উল্লেখ করেন আমেরিকার মর্মান্তিক ৯/১১ হামলার কথা।
সেখান থেকে নির্বিঘ্নে তিনি ভাগবতের জন্মদিন প্রসঙ্গে আসেন। তাকে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত, সামাজিক রূপান্তর, সম্প্রীতি ও সৌভ্রাতৃত্বের জন্য জীবন উৎসর্গকারী নেতা বলে বর্ণনা করেন। লেখার এই অংশটি পড়লে বিভ্রম হয়, প্রধানমন্ত্রী এ কথা কার উদ্দেশে বলছেন, ভাগবত নাকি স্বামীজি! ভাগবতের পিতা মধুকর রাও ভাগবতের সঙ্গে কাজ করার স্মৃতিচারণ করে মোদি লেখেন, আরএসএসের শতবর্ষের ইতিহাসে ভাগবতের সময়কালই ‘সবচেয়ে পরিবর্তনশীল’ অধ্যায়। প্রধানমন্ত্রী তার লেখনীতে সংঘের পোশাকবদল থেকে প্রশিক্ষণ শিবির এবং কোভিড সংকটে স্বয়ংসেবকদের তৎপরতার উদাহরণ টেনে ধরেন।
সময়টিও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভাগবতের জন্মদিনের মাত্র ছ’দিন পরেই জীবনের পঁচাত্তর বছর পূর্ণ করবেন মোদি নিজে। গত জুলাইয়ে নাগপুরে সংঘের মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই ভাগবতই মন্তব্য করেছিলেন, ৭৫ বছর বয়সেই রাজনৈতিক অবসর নেওয়া উচিত, যা সরাসরি মোদির দিকে ইঙ্গিত করে বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। তবে গত মাসে দিল্লীতে আরএসএস সম্মেলনে পুরনো অবস্থান থেকে নাটকীয় বাঁকবদল করে সংঘপ্রধান জানিয়ে দেন, তিনি ৭৫-এ ইস্তফা দেবেন না, অন্য কাউকেও ইস্তফার পরামর্শ দিচ্ছেন না। অতঃপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন বিজেপি নেতৃত্ব। আত্মতৃপ্তির এ-হেন বাতাবরণে ভাগবতের জন্মদিনে সংবাদমাধ্যমে মোদির দীর্ঘ প্রবন্ধ এক ধরনের দিক নির্দেশনাও বটে, সেটি হলো, ৭৫ বছর কোনো নীতি নয়, বরং একটি অস্ত্র। রামমন্দির আন্দোলনের দুই স্তম্ভ আদবানী-যোশীর বিরুদ্ধে তা ব্যবহার হয়েছে বটে, কিন্তু ভাগবতের ক্ষেত্রে তা যেমন প্রযোজ্য হয়নি, মোদির ক্ষেত্রেও যেন তার অন্যথা না হয়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মোদির এই প্রবন্ধ যতখানি শ্রদ্ধাঞ্জলি, তার চেয়ে অধিক বিল।
এই দ্বিমুখী মানদণ্ড প্রকট। বিজেপিতে ৭৫ বছরের ছাঁকনি লালকৃষ্ণ আদবানী, মুরলী মনোহর যোশী, সুমিত্রা মহাজন, কলরাজ মিশ্র, জেনারেল খান্ডুরী, অরুণ শৌরি, শান্তা কুমার, ইয়েদুরাপ্পা প্রমুখ দিগ্গজদের প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু ভাগবত ও মোদির ক্ষেত্রে নিয়মটি সহসাই নমনীয়, বস্তুত অচলপয়সায় পরিণত। বিরোধীদের মতে, সংঘপ্রধানের প্রশ্রয় আর প্রধানমন্ত্রীর প্রণতি আসলে পারস্পরিক বোঝাপড়া, ভাগবত প্রভাব রাখবেন, মোদি বৈধতা পাবেন। তাই সমস্ত বাহুল্য স্তুতির আড়ালেও প্রধানমন্ত্রী প্রণীত প্রবন্ধটি নিছক শ্রদ্ধাঞ্জলি নয়। এটি কার্যত এক অঘোষিত দরকষাকষি, নাগপুর-দিল্লীর ব্যবধান কমানোর কৌশল এবং বিজেপি ও সংঘ কর্মীদের জন্য এই মর্মে প্রচ্ছন্নে বার্তা যে, নেতৃত্বের প্রশ্ন আপাতত অতীত। এতদসত্ত্বেও মৌলিক প্রশ্ন থেকেই যায়, বিজেপির নিয়ম কি নীতি দিয়ে চালিত, নাকি ক্ষমতার সুবিধা মতো প্রয়োগ করা হয়? আরও একটি তাৎপর্য অনস্বীকার্য, দেশের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংবাদপত্রে আরএসএস প্রধানকে স্তুতি করে প্রবন্ধ লিখছেন। এতে একদিকে বিজেপি-সংঘের আদর্শিক নাভিশ্বাসের বন্ধন প্রকাশ পায়, অন্যদিকে বোঝা যায়, ৭৫-এর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে মোদির নিজের অবস্থান কতখানি অনিশ্চিত।
শেষ পর্যন্ত বলার এই প্রবন্ধে যতটা মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়েছে তার তুলনায় বরং প্রশ্নই উঠেছে বেশি। তবে কি ‘৭৫ বছরের নিয়ম’ এখন থেকে চিরতরে বাতিল, নাকি প্রয়োজনে আবার তাকে স্বধর্মে থিতু করা হবে? মোদির প্রশংসা কি খাঁটি ভক্তি, নাকি রাজনৈতিক বাস্তবতার সামনে ট্যাকটিকাল নতজানু? আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন – যখন অবসরের নিয়মকে নীতি নয়, ক্ষমতার সুবিধা হিসাবেই ব্যবহার করা হয়, তখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের স্বাস্থ্য কতটা সুরক্ষিত থাকে?

Dainik Digital: