কলকাতার উপকণ্ঠে উত্তর চব্বিশ পরগনার পানিহাটির একটি ঘরে সম্প্রতি পাখা থেকে ঝুলছিল এক প্রৌঢ়ের দেহ। টেবিলের উপর পড়ে ছিল একটি ডায়েরি, তারই দেড় পৃষ্ঠা জুড়ে লেখা আত্মঘাতী প্রৌঢ়ের শেষ স্বীকারোক্তি, আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী এনআরসি ও এসআইআর আতঙ্ক।
জনৈক প্রদীপ করের (৫৭) এই মৃত্যু শুধু এক ব্যক্তির আত্মহনন নয়, বরং নাগরিক পরিচয়ের নাম করে তৈরি হওয়া এক গভীর রাষ্ট্রীয় আতঙ্কের প্রতীক। একজন সাধারণ নাগরিকের এ ভাবে জীবন শেষ হয়ে যাওয়া আদতে নীতি বনাম মানবিকতার সংঘর্ষের এক করুণ কাহিনি, যা বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখলে ভারতীয় সংবিধান ও গণতন্ত্রের প্রতি গভীর আঘাত, সেই সঙ্গে রাজনৈতিক বিস্ফোরনও বটে। আত্মঘাতী প্রৌঢ়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য পরোক্ষে দায়ী কে? প্রশাসনিক প্রেক্ষাপট, নাকি ক্ষমতাতন্ত্রের বিষাক্ত প্রচারের প্রত্যক্ষ পরিণতি, উত্তর দেবে সময়।
এনআরসি (জাতীয় নাগরিকপঞ্জি) আর এসআইআরর (বিশেষ নিবিড় সংশোধন), এই দুটি শব্দ এখন দুর্ভাগ্যজনক ভাবে কাগজের চেয়ে অনেক বেশি এক মানসিক দুঃস্বপ্নের নাম। তিন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল-সহ মোট বারটি রাজ্যজুড়ে প্রশাসনিকভাবে ‘তালিকা সংশোধন’-এর রাজসূয় যজ্ঞ প্রারম্ভের সূচনাতেই ওই মৃত ব্যক্তির মতো বহু মানুষ ঘরে ঘরে শঙ্কিত-নাম বাদ যাবে কিনা, ভোটাধিকার হারাব কিনা, নাগরিকত্ব নিয়ে জেরার মুখে পড়তে হবে কিনা ইত্যাদি। বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি আঙুল তুলেছেন কেন্দ্রীয় শাসকের দিকে। এই ঘটনাকে তিনি ‘বিভাজনের রাজনীতির পরিণাম’ বলে উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে বিজেপির বক্তব্য, এই ঘটনাকে ‘এনআরসি আতঙ্ক’ বলে চালানো তৃণমূলের রাজনৈতিক চাল ছাড়া কিছু নয়। দলের আইটি সেলের প্রধান অমিত মালবিয়া বলেছেন, একজনের আত্মহত্যা দিয়ে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে, যা নির্লজ্জ রাজনীতি। তিনি ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন একটাই, রাজনীতি নয়, বাস্তব কী? সারা দেশে ‘স্বচ্ছ’ ভোটার তালিকা তৈরির উদ্দেশ্যে চলা বিশেষ নিবিড় সংশোধন প্রক্রিয়ায় এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নাম বাদ পড়েছে বিহারে, অথচ রাস্তায় কোনও প্রতিবাদ হয়নি! কারণ, অনেকেই জানেনই না তাদের নাম বাদ গেছে কি না। বিরোধীরা বলছে, তালিকা সংশোধনের নামে গোপনে নাগরিক বাছাই চলছে। তবে এতে কোনও মঞ্চের নেই যে ভোটার তালিকার আমল সংশোধনের নামে যদি রাষ্ট্র সন্দেহের দেয়াল তোলে, মানুষ নিজের দেশেই পরবাসী হয়ে পড়ে।এই ভয়ই কি জনৈক প্রদীপ করের মতো সাধারণ মানুষকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কিনা সে প্রশ্নই উঠবেই। এসআইআর একটি রুটিন প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, যা সাংবিধানিক পদ্ধতি মেনে সম্পন্ন হওয়াই
বিধেয়।যদি সেটাই হয়, তা হলে এই নিয়ে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মুখ্য নির্বাচনি কমিশনার এত ওজনদার বক্তব্য পেশ করে এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছেন কেন?কমিশনের দাবি, তারা একেবারে ন্যায্য পথে, সংবিধানে বিধৃত প্রতিটি অক্ষর মেনে এগোচ্ছে।
এক্ষণেও প্রশ্ন জাগে, সুপ্রিম কোর্টে এসআইআর মামলা এখনও বিচারাধীন।সেই মামলা নিষ্পত্তির আগেই এতগুলো রাজ্যে একযোগে
এসআইআর চালু হয়ে গেল কেন? এ কি নিছক প্রশাসনিক তাগিদ,নাকি রাজনৈতিক তাড়া? মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসের ঘাটতি দূর করাটাই শাসকের কর্তব্য, আতঙ্ক জাগিয়ে তোলা নয়।ভোটাধিকার
গণতন্ত্রের স্তম্ভ। গণতন্ত্রের সামান্য চাহিদা, প্রতিটি ভোটারের অধিকার যেন রক্ষিত হয়।
বঙ্গের ওই প্রৌঢ়ের মৃত্যু একক ঘটনা নয়, এক প্রতীক। যেই প্রতীকের পিছনে আছে এক ভয়ানক প্রশ্ন: কাগজে নাম না থাকলেই কি মানুষ ‘অবৈধ’? একটা সিল, একটা ডেটা এন্ট্রি কি মুছে দিতে পারে নাগরিকত্ব, যেটা অর্জিত রক্ত, পরিশ্রম এবং প্রজন্মের বসতি গড়ে? ক্ষমতার জন্য বিভাজনকে হাতিয়ার করা রাজনীতির এই নতুন অধ্যায়, যা চরম অনভিপ্রেত। যখন নাগরিকরতার প্রমাণই হয়ে উঠছে অস্তিত্বের: শর্ত, তখন প্রতিটি নামের পিছনে এক একটি হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার আশঙ্কা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হোক বা অমিত শাহ, দুই পক্ষকেই একটি প্রশ্ন করা অতীব জরুরি, মানুষের ভয় নিয়ে রাজনীতি চলবে, নাকি মানুষকে যথাযথ নিরাপত্তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে? রাষ্ট্র যদি নাগরিকের উপর সন্দেহ করতে শুরু করে, তাহলে নাগরিক আর কতদিন রাষ্ট্রের উপর আস্থা রাখবেন? সাংবিধানিক গণতন্ত্রকে এমন ভয়ের রঙ্গমঞ্চে পরিণত করা কতখানি সমর্থনযোগ্য, মানুষকে তাদের অস্তিত্বের অধিকার নিয়ে সন্দেহ করতে বাধ্য করা কতখানি সমর্থনযোগ্য, তারও উত্তর দেবে সময়।