রাজনীতির ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত থাকে যা কেবল এক শহরের নয় রাএক এক মহাদেশেরও প্রতীক হয়ে ওঠে। নিউইয়র্ক সিটির নতুন মেয়র জহরান মামদানি সেই মুহূর্তের জন্ম দিয়েছেন। আর তার মুখে জওহরলাল নেহরুর নাম শুনে যেভাবে নয়াদিল্লীর ক্ষমতার করিডরে নীরবতা নেমে এসেছে তা নিছক কাকতালীয় নয়।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেরুকরণ রাজনীতিকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করা আমেরিকা যখন নতুন দিক খুঁজছিল, তখন মামদানি বিজয়ের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন- ‘এক সময় আসে, যখন পুরনো শেষ হয়, নতুন শুরু হয়’। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রাক্কালে নেহরুর এই বাক্য আবার ফিরে এলো মার্কি মাটিতে। শুধু উদ্ধৃতি নয়, এটি ছিল এক রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা যা সরাসরি আঘাত করল নরেন্দ্র মোদির ‘নতুন ভারত’ দর্শনের হৃদয়ে। ভারতের শাসকরা গত এক দশকে যে একটিই কাজ সবচেয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে করেছে, তা হলো- নেহরুর নামকে কলঙ্কিত করা।
দেশের প্রতিটি সমস্যার মূল খুঁজে বের করে তারা একটাই উত্তর দেয়-‘নেহরু দায়ী।’ সীমান্তে সমস্যা? নেহরু দায়ী। অর্থনীতি দুর্বল? নেহরু দায়ী। সংখ্যালঘুদের প্রতি সহনশীলতা? সেটিও নেহরুর ‘অপরাধ’। এই রাজনীতি আসলে এক ধরনের মানসিক পরাজয়ের বহিঃপ্রকাশ- যেখানে বর্তমানের ব্যর্থতাকে ঢাকতে ইতিহাসকে পুড়িয়ে ছাই বানানো হয়।নেহরুকে অহংকারী বলা হয়, কিন্তু যিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত এক দেশকে বিজ্ঞান, শিল্প, শিক্ষা ও গণতন্ত্রের পথে দাঁড় করিয়েছিলেন, তাঁকে দোষারোপ করা মানে নিজের আত্মবিশ্বাসের দেউলিয়া ঘোষণা।আজকের সরকার ইতিহাসের আয়নায় তাকাতে ভয় পায়, কারণ সেখানে দেখা যায়-একজন নেহরু, যিনি ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবিকতার পতাকা তুলেছিলেন, আর অন্যপাশে দেখা যায়-বর্তমান ভারতকে অন্য রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার এক ভিন্ন রাজনৈতিক প্রয়াস।মামদানি তার বিজয় ভাষণে শুধু ট্রাম্পকে নয়, গোটা বিশ্বকে বার্তা দিয়েছেন- ‘আলো এখনও জ্বলে।’ তিনি বলেছেন, ‘এই রাজনৈতিক অন্ধকারের মুহূর্তে নিউইয়র্ক হবে আলোর উৎস’।এই অন্ধকার শব্দটি যে শুধু আমেরিকার প্রেক্ষিতে বলা নয়, তা বুঝতে বিশেষ বুদ্ধির দরকার হয় না। এটি ছিল এক রাজনৈতিক প্রতীক- যেখানে ট্রাম্পের সঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পড়েছেন মোদিও।একটা কথা প্রায়শই বলতে শোনা যায়, দুই নেতার রাজনীতির মডেল এক-ভয়’ ও ‘বিভাজন।একজন মুসলিম বিদ্বেষে পুষ্ট, অন্যজন সংখ্যালঘুদের ‘অন্য ভারতীয়’ বানাতে ব্যস্ত।একজন দেয়াল তুলেছিলেন মেক্সিকো সীমান্তে, অন্যজন তুলছেন ঘৃণার প্রাচীর নিজের দেশের ভেতরেই।এই দুই মেরুকরণ-রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যখন নেহরুকে উদ্ধৃত করেন, তখন সেটি নিছক ইতিহাসচর্চা নয়- এটি প্রতিরোধের এক সাংস্কৃতিক প্রতীক হয়ে ওঠে। বিজেপির নেহরু- বিরোধিতার পেছনে আসলে এক গভীর ঈর্ষা কাজ করে।কারণ,নেহরু ছিলেন এমন এক রাষ্ট্রনায়ক, যিনি কোনও ধর্ম বা গোষ্ঠীর নয়, পুরো জাতির কণ্ঠস্বর হতে পেরেছিলেন।যিনি চিনের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়েও মেরুদণ্ড সোজা রেখে লড়েছিলেন- তাকে আজকের কৃত্রিম ‘চৌকিদার’ রাজনীতি বুঝবে না। নেহরু ছিলেন সেই ভারতীয়, যিনি জানতেন সভ্যতার শক্তি মন্দির বা মসজিদে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে জন্ম নেয়। এই বোধটাই আজকের শাসকদলকে সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে ফেলে- কারণ তারা জানে, যুক্তিবাদ আর সহনশীলতা যত বাঁচে, তাদের রাজনীতি ততই মরে।অনেক সময়েই শাসকেরা নিজের মতো করে ইতিহাসের মোড় ঘোরাতে চায়। বর্তমান সময়ের শাসকের মধ্যেও হয়তো এমনই এক ভাবনা কাজ করছে যে, নেহরুকে মুছে ফেললেই ইতিহাস নতুনভাবে লেখা যাবে। কিন্তু ইতিহাসের এক অদ্ভুত অভ্যাস আছে- যাদের মুছতে চাওয়া হয়, তারাই ফিরে আসে আরও বড় প্রতীক হয়ে।আজ নেহরুর নাম উচ্চারিত হচ্ছে নিউইয়র্কের মঞ্চে, মামদানির মুখে। এমন এক তরুণী প্রবাসী মুসলিম রাজনীতিক, যিনি নেহরুর ‘নিয়তির সঙ্গে অঙ্গীকার’-এর ভাষণকে পুনরুজ্জীবিত করলো- যা বিজেপির জন্য কেবল কূটনৈতিক নয়, ভাবাদর্শগতও এক ধাক্কা।আজ নেহেরুকে স্মরণ করা মানে, ইতিহাসের অজুহাত নয়-এটি এক প্রতিরোধের ভাষা।যে সময় দেশের স্বাধীনতার মর্ম ভুলে গিয়ে ‘ভিন্নমত’ কে দেশদ্রোহ বলে তকমা দেওয়া হয়, সেই সময় নেহরুর বাণী ফিরে আসে ‘আলো’ হয়ে।জহরান মামদানি সেই আলোকবর্তিকা জ্বেলে দিলেন নিউইয়র্কে-যেখানে ভারতীয় রাজনীতি আজ অন্ধকারে ঘুরপাক খাচ্ছে। রাজনীতিতে কেউ কেউ হয়তো ভাবছে, নেহরু অতীত। কিন্তু ইতিহারে নির্মম সত্য হলো-যাদের আদর্শ-মুছে ফেলতে চাওয়া হয়, তারাই ভবিষ্যতের দিকে আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলে ওঠে। মামদানির কন্ঠে তাই নেহরু কেবল সাতি নন-তিনি আজও বর্তমান এবং আরও ভয়ংকরভাবে প্রাসঙ্গিক।