কালের চক্রে ফিরে এসেছে দুর্গোৎসব। আজ মহাষষ্ঠী।শুরু হচ্ছে বাঙালির সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মিলন, শারদীয় দুর্গোৎসব। মার্কণ্ডেয় পুরানের ‘শ্রীশ্রী চণ্ডী’র বর্ণনানুযায়ী, মহাষষ্ঠীর অর্থ কবচ, অর্গল, তিলক পাঠ করে দেবীকে আহ্বান করা, দেবীর আশীর্বাদ কামনা করা। কবচের উদ্দেশ্য, দুর্গা দেবীর বিভিন্ন অঙ্গ দ্বারা রক্ষা পাওয়া। ‘অহং ব্রহ্মাণ্ডময়্যাই নামা, মায়া মহিমা কৃপা করুণাময়ী’, অর্থাৎ মাথায় শরণং দেবী, চোখে চামুণ্ডা, কপালে কালিকা, গলায় বৈষ্ণবী, হাতে বরাহী, পায়ে কাশী। অর্গল হল দেবীর আশীর্বাদ ও কৃপা প্রার্থনা, জয়ন্তী মঙ্গলা কালী, ভদ্রকালীণ কপালিনী / দুর্গা দুর্গতি বিনাশিনী, নরকে যশঃ শ্রীঃ দানিনী-অর্থাৎ জয়ন্তী, মঙ্গলময়, বিপদ বিনাশকারী দুর্গা, মানুষের কল্যাণ ও কৃপা করুন। আর কিলকের উদ্দেশ্য সাধনার ‘তালা খোলার’ মন্ত্র ওঁ হ্রীং ক্রীং চামুণ্ডায়ৈ বিবচে, অর্থাৎ দেবী শক্তি, অসুর দমনকারী, ভক্তদের আশীর্বাদ করুন।
শরৎকাল দক্ষিণায়নের সময়। দেবতাদের রাত্রিকাল। তাই শরৎকাল পূজার্চনার উপযুক্ত কাল নয়। অকালে দেবতার পূজা করতে হলে তাকে জাগরিত করতে হয়। জাগরণের এই প্রক্রিয়াটিকেই বলা হয় ‘বোধন’। মহাশক্তির মহাপূজার সূচনা হয় বোধনের মধ্য দিয়ে। মহাষষ্ঠীতেই দেবীকে উদ্বোধিত করা হয়।এদিনই দেবী দুর্গার বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পাঁচ দিনের পূজার আনুষ্ঠানিকতা।
মাত্র পাঁচ দিনের এই মহোৎসবে শুধু ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি বাঙালি সমাজের সমষ্টিগত অভিব্যক্তি, যেখানে ধনী-দরিদ্র, মধ্যবিত্ত- উচ্চবিত্ত, সকলেই মায়ের আরাধনায় একত্রিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ হয়, সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ’ দুর্গাপূজা তাই কেবল দেবীপূজা নয়, বরং মানবিক সৌহার্দ্য, উদারতা ও সামাজিক মিলনের উৎসব। দুর্গা পূজার শাস্ত্রীয় ভিত্তি মূলত দর্শন, পৌরাণিক কাহিনি ও পূজার্চনা। শাস্ত্র অনুযায়ী, দেবী দুর্গা দৈত্য, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রু থেকে রক্ষা করেন। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবসহ সকল দেবতার শক্তি তাঁর মধ্যে মিলিত। ‘দুর্গা’ নামের ব্যাখ্যায় ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কারক বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক এবং ‘আ-কার’ ভয়-শত্রুনাশক হিসেবে চিহ্নিত। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ, ভয় ও শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। অপরদিকে শব্দকল্পদ্রুম অনুসারে ‘দুর্গ’ নামক অসুরকে যিনি বধ করেন তিনিই দুর্গা। শ্রীশ্রীচণ্ডীর বর্ণনানুযায়ী দুর্গা সকল দেবতার সম্মিলিত এক মহাশক্তির প্রতিমূর্তি। তিনিই মহাশক্তি এবং জগতের মূল কারণ। তিনি বিষ্ণু ও শিবাদি দেবগণেরও অজ্ঞাত। তিনি সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণময়ী, ব্রহ্মা থেকে কীট পর্যন্ত এ নিখিল চরাচর তাঁরই অঙ্গাংশ। কারণ তিনিই সবার আশ্রয়-রূপিণী। তিনি চিন্ময়ী, পরমাপ্রকৃতি। তিনিই শাক্তদের মহামায়া, বৈষ্ণবদের বিষ্ণুমায়া এবং শৈবদের শিবশক্তি। মাতৃরূপিণী মহাশক্তি দুর্গা অশুভ শক্তির কবল থেকে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ও ভক্তকুলকে রক্ষা করেন। এই অমিত চেতনার সঙ্গে আবহমান বাংলার লোকজ সংস্কৃতি যুক্ত করে দেবী দুর্গাকে বাঙালি হিন্দু সমাজ ‘ঘরের মেয়ে’ হিসেবেই বরণ করে নেয়। মার্কণ্ডেয় পুরাণের শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবীর আবির্ভাব ও অসুর বধের কাহিনি বর্ণিত। মধু-কৈটব, মহিষাসুর ও শুম্ভ-নিশুম্ভ বধের মাধ্যমে মায়ের শক্তি, সুরক্ষা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার শিক্ষণীয় বার্তা মেলে। মানুষের দম্ভ, ক্রোধ, লোভ ও মোহের অবসান ঘটাতেমাতৃরূপ মহামায়ার পূজা অপরিহার্য। যেমন রাজা সুরথ এবং বৈশ্য সমাধির কাহিনি দেখায়, পূজা করলে কেউ দৈনন্দিন দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে পারে।
দুর্গামূর্তি বাঙালির নিজস্ব সৃজনশীল কল্পনার ফল। মাটির প্রতিমা, ঢাকি-চুলি, আলোকসজ্জা, আরতি ও সঙ্গীত, সবই এই উৎসবকে জীবন্ত করে তোলে। মা দুর্গা যেমন কার্তিকেয়, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতীসহ পরিবার সমেত বাপের বাড়িতে আসেন, তেমনই বাঙালিরা পরিবার নিয়ে পূজায় অংশগ্রহণ করে। মায়ের উপস্থিতি, সংহতি ধনশক্তি, বীর্য ও জ্ঞান মিলিত হলে জীবনে দুর্গার অধিষ্ঠান ঘটে এবং সমস্ত দুর্গতি দূর হয়। শারদীয় দুর্গোৎসব তাই কেবল দেবীপুজা নয়, এটি বাঙালির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সামাজিক চেতনার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এই উৎসবের আনন্দ উপভোগ করে, মায়ের স্নেহ, শক্তি ও মহিমা উপলব্ধি করে। প্রতিটি বাঙালি হৃদয় জানে, এই পাঁচদিনের মিলনে শুধুমাত্র দেবী নয়, সমস্ত মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধও পূর্ণতা পায়। দুর্গাপূজা তাই জীবনের দুঃখ দূরীকরণ, ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং মানবিক একতার এক মহান উদ্যাপন।